ডিএনসিসি’র দরপত্র কারসাজি নিয়ে কি কি অভিযোগ ?
ডিএনসিসি’র রামপুরা সেতু থেকে কুড়িল মোড় পর্যন্ত সড়কের জন্য সড়কবাতি স্থাপনের দরপত্র প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
গত ১ জুন এই দরপত্র ডাকা হয়েছিল। এই কেনাকাটার দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল গত ২৯ জুন। তবে ২৬ জুন শর্ত পরিবর্তনের পর দরপত্র জমার সময় বাড়িয়ে ১০ জুলাই নির্ধারণ করা হয়। দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। জেএপি দর দেয় ৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এসএস রহমান ইন্টারন্যাশনাল দেয় ৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। যদিও ঢাকা ওয়াসার অর্থায়নের এই কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৯ কোটি টাকার বেশি।
এই অভিযোগগুলো নিম্নরূপ:
‘খাতিরের’ ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে কারসাজি:
অভিযোগ উঠেছে যে ডিএনসিসির দরপত্র প্রক্রিয়ায় ‘খাতিরের’ ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার জন্য কারসাজি করা হয়েছে। সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স জেএপি ট্রেডিং-এর সঙ্গে ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগের বিদ্যুৎ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সাইফুল ইসলামের যোগসাজশের অভিযোগও রয়েছে। যদিও সাইফুল ইসলাম এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
আরও দেখুনঃ Feasibility Study প্রকল্পের সংশোধন ও মেয়াদ বৃদ্ধি প্রক্রিয়া
শর্ত পরিবর্তন ও সময়সীমা বর্ধিতকরণ:
দরপত্র জমাদানের সময়সীমা শেষ হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে শর্ত বদলানো হয়। শর্ত বদলানোর পর দরপত্র জমার সময় বাড়িয়ে ১০ জুলাই নির্ধারণ করা হয়, যা মূলত ২৯ জুন শেষ হওয়ার কথা ছিল।
এই শর্ত পরিবর্তনে কারিগরি কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে পক্ষপাতিত্ব করার জন্য করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ উঠেছে।
নির্দিষ্ট শর্তাবলী পরিবর্তন:
দরপত্র জমাদানের সময়সীমা শেষ হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে অনেকগুলো শর্ত বদলানো হয় যার মধ্যে ১টি অন্তত অধিক সন্দেহের উদ্রেক করেছে, যেমনঃ
- নতুন করে একটি শর্ত যোগ করা হয় যে, সিএমএসের সোর্স কোড সরবরাহ করতে হবে। ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের ধারণা, ঠিকাদার জেএপিকে স্থানীয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এনার্জি প্লাস আগে থেকেই সোর্স কোড দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। সাধারণত কোনো আন্তর্জাতিক বা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি নিজেদের সফটওয়্যারের সোর্স কোড দেয় না, কারণ এর মূল্য অনেক এবং এটি অত্যন্ত গোপনীয়।
এছাড়াও, বাকি যে শর্তগুলোও পরিবর্তন করা হয়েছে সেগুলো হলোঃ
- প্রথম দরপত্রে পণ্যের গুণগত নিশ্চয়তার জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ চাওয়া হয়েছিল, যা সংশোধিত শর্তে বাদ দিয়ে শুধু ‘প্রতিষ্ঠিত সংস্থা’ থেকে সনদ দেওয়ার কথা বলা হয়।
- প্রথমে শর্ত ছিল, বাতি, ড্রাইভার, ডিসিইউ (একাধিক বাতি একত্রে সমন্বয়ের ব্যবস্থা) ও সিএমএস (সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) একই ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানের হতে হবে। পরে তা পরিবর্তন করে শুধু ডিসিইউ ও সিএমএস একই প্রতিষ্ঠানের হতে হবে বলা হয়।
- প্রাথমিকভাবে বাতির ড্রাইভার ফিলিপস জাইটানিয়াম (পোল্যান্ডের তৈরি) হতে হবে বলা হলেও পরে এর ‘সমমান বা সমতুল্য’ যোগ করা হয়।
- পণ্য ইউরোপের যেকোনো দেশের বন্দর থেকে আনার শর্ত পরিবর্তন করে দরদাতা যে বন্দর উল্লেখ করবে, সেটিই প্রযোজ্য বলে শর্ত যোগ করা হয়।
নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের (জেএপি) মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থতা:
- জেএপি এলইডি বাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলভিডি ও আরওএইচএস সনদ জমা দেয়নি। আরওএইচএস সনদ পরিবেশে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে এবং এলভিডি সনদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তামান পূরণের স্বীকৃতি।
- জেএপি ডিসিইউ ও সিএমএসের জন্য প্রস্তুতকারীর কোনো স্বীকৃত সনদ জমা দেয়নি, বরং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এনার্জি প্লাস নিজেদের প্যাডে একটি ‘ডিক্লারেশন’ দিয়েছে।
- শর্ত অনুযায়ী বাতির ড্রাইভারে ডাবল আইসোলেশন (ক্লাস-২ মানের) থাকতে হবে, কিন্তু জেএপি চীনা প্রতিষ্ঠানের সিঙ্গেল আইসোলেশন ক্লাস-১ মানের ড্রাইভার দিচ্ছে।
- জেএপি ভোল্টেজ, পাওয়ার ফ্যাক্টর এবং সিস্টেম লুমেন টলারেন্সের শর্ত পূরণ করতে পারেনি।
- এলইডি বাতি ও সিএমএস একই কোম্পানির হওয়ার কথা থাকলেও জেএপি চীনা প্রতিষ্ঠান শ্রেডারের এভানতো সিরিজের বাতি এবং এনার্জি প্লাসের সিএমএস সরবরাহ করছে, যা পরিচালনায় জটিলতা তৈরি করবে বলে ডিএনসিসির প্রকৌশলীরা মনে করেন।
পরিশেষ:
জেএপি চীনা প্রতিষ্ঠান শ্রেডার লাইটিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোং লিমিটেডের এভানতো সিরিজের এলইডি বাতি সরবরাহ করবে। এই বাতিগুলোর আন্তর্জাতিক মূল্য ৬০-৭০ মার্কিন ডলার (প্রায় ৭,৩০০-৮,৫০০ টাকা)। শুল্ক ও কর যোগ হলেও দেশে প্রতিটি বাতির দাম ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে থাকে। অথচ দরপত্রের প্রাক্কলনে উন্নত মানের বাতির জন্য প্রতিটি বাতির দাম ধরা হয়েছিল এক লাখ টাকার কাছাকাছি।
ডিএনসিসির একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিম্নমানের বাতি দেওয়ার সুযোগ নিয়েই জেএপি প্রাক্কলিত দামের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কম দরপ্রস্তাব করেছে।
ডিএনসিসির প্রশাসক এই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হলে কাজ বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের আশ্বাস দিয়েছেন।
বিস্তারিত দেখুনঃ ‘খাতিরের’ ঠিকাদারকে কাজ দিতে ডিএনসিসির ‘দরপত্রে কারসাজি’
এই লেখকের অন্যান্য লেখা

কখন ভেরিয়েশন কমিটি প্রয়োজন নেই ?
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গত ৪ঠা মে ২০২৫ ইং তারিখে “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫” এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে

ভেরিয়েশন কে অনুমোদন করবেন (পিপিআর ২০২৫ অনুসারে) ?
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গত ৪ঠা মে ২০২৫ ইং তারিখে “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫” এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে

ভেরিয়েশন প্রক্রিয়াকরণের সময়সীমা কত (পিপিআর ২০২৫)
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গত ৪ঠা মে ২০২৫ ইং তারিখে “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫” এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে

ভেরিয়েশন কমিটি কি, কে অনুমোদন করবে, কাজ কি ?
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গত ৪ঠা মে ২০২৫ ইং তারিখে “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫” এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে