পর্তুগালে ই-প্রকিউরমেন্ট
e-Procurement in Portugal
Md Saifur Rahman Joarder
তারিখঃ ৫ ডিসেম্বর ২০১৬
ভূমিকাঃ পর্তুগালের e-Procurement System সম্পর্কে জানার লক্ষ্যে অতি সম্প্রতি (বিগত ১৪-১৭ নভেম্বর, ২০১৬ পর্যন্ত) পর্তুগালে আয়োজিত একটি বৈদেশিক প্রশিক্ষন কোর্সে অংশগ্রহনের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১০ জন কর্মকর্তার একটি দলের সদস্য হিসাবে আমি মনোনীত হই। পরবর্তীতে উক্ত সময়ে আমি পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে প্রশিক্ষনের উদ্দেশ্যে অবস্থান করি এবং পর্তুগালের e-Procurement কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারী/বেসরকারী অফিস পরিদর্শনপূর্বক উক্ত অফিসসমূহ কর্তৃক পরিচালিত কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পাশাপাশি তাদের কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করি। এ প্রেক্ষাপটে গত ১৮/১১/২০১৬ ইং তারিখে পর্তুগালের e-Procurement বিষয়ে আমার অর্জিত অভিজ্ঞতা বন্ধু/সহকর্মীদের সাথে Share করার উদ্দেশ্যে আমার Facebook Page-এ ইংরেজীতে Post করি। আমার ভ্রমনকালীন সময়ে শুধুমাত্র কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করে Facebook Page-এ Post করা ইংরেজীতে লেখাটির বাংলায় অনুদিত ভার্সন www.procurementbd.com ওয়েবসাইটে শেয়ার করার জন্য আমার বন্ধু ও সহকর্মী জনাব মুহাম্মদ শরিফুল ইসলাম আমাকে অনুরোধ করেন। এখানে বাংলায় অনুদিত পোষ্টটি (প্রাথমিকভাবে বাংলায় একটি খসড়া অনুবাদে সহায়তা করেছেন আমার বন্ধু ও সহকর্মী জনাব মুহাম্মদ শরিফুল ইসলাম, তার এ উদ্যোগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি) আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযুক্তপূর্বক পুনরায় সকলের সুবিধার্থে শেয়ার করলামঃ
আমার দিক থেকে এটি একটি খুব-ই অনানুষ্ঠানিক/অপেশাদারী লেখা। খুব সম্প্রতি লিসবন ভ্রমণের সময় পর্তুগাল এর e-Procurement সিস্টেম সম্পর্কে আমার জানার/শেখার সুযোগ হয়েছিল। তার আলোকে প্রকিউরমেন্ট এর সাথে সম্পর্কিত, আগ্রহী আমার সহকর্মীবৃন্দ এবং বাংলাদেশে e-Procurement পদ্ধতি ব্যবহার করে কাজ করছেন; এমন সকলে এই লেখাটি পড়ে পর্তুগালের ক্রয়-পদ্ধতি, ক্রয় প্রক্রিয়া ও রীতি-নীতি সম্পর্কে কিছু নতুন ধারণা পাবেন বলে আমি আশা রাখি।
এখানে আমি শুধুমাত্র বাংলাদেশ এবং পর্তুগালের e-Procurement সিস্টেমের মধ্যে দৃশ্যমান কিছু পার্থক্য তুলে ধরার চেষ্টা করলামঃ
১) পর্তুগাল সরকার সরকারী ক্রয় প্রক্রিয়ায় বিগত ২০০৮/২০০৯ সালে e-Procurement চালু করে। বাংলাদেশে ২০১১ সালে e-GP সিস্টেম চালু করা হয়।
২) পর্তুগালে e-Procurement পোর্টাল ব্যবহারের জন্য ৬টি ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যা আবার ৬টি পৃথক বেসরকারী (প্রাইভেট) কোম্পানী দ্বারা পরিচালনা (অপারেট) করা হয়। এদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় একটি অপারেটর কোম্পানী VORTAL (হরতাল নয়)-এর সদর দপ্তর পরিদর্শনের সুযোগ আমাদের হয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে e-GP সিস্টেমের একমাত্র অপারেটর হচ্ছে সিপিটিইউ এবং সিস্টেমটি প্রাইভেট কোম্পানী DOHATECH এর সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে।
৩) পর্তুগালের এই ৬টি e-Procurement প্ল্যাটফর্ম প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ক্রয়কারী, সরবরাহকারী বা সেবা প্রদানকারী হিসেবে সরকারী সংস্হার পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবহার করতে পারেন। একই সাথে উল্লেখ্য যে, VORTAL বা অন্য অপারেটররা শুধুমাত্র পর্তুগালেই তাদের সেবা সীমাবদ্ধ রাখেননি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভূক্ত এবং এর বাইরে আরো কয়েকটি দেশেও তারা একই ধরনের সেবা প্রদান করে আসছেন এবং পর্তুগালের বাইরে অন্যান্য দেশের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানসমূহও এদের প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে পারেন।
৪) পর্তুগালে সরকারী/বেসরকারী সংস্থা উভয়কেই অন্তত যে কোন একজন অপারেটরের একটি প্ল্যাটফর্ম নির্বাচন করে নিবন্ধন (Register) করতে হয়। এসব নিবন্ধনের জন্য নির্বাচনকৃত অপারেটরকে সংশ্লিষ্ট সংস্থা হতে একটি বার্ষিক ফি প্রদান করতে হয়। সেবা প্রদানকারীদের ক্ষেত্রে (যথাঃ ঠিকাদার ও পরামর্শক) এই নিবন্ধন বিনামূল্যে দেয়া হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশে e-GP পোর্টাল ব্যবহারের ঠিক বিপরীত চিত্র।
৫) ক্রয়কারী (PE: Procuring Entity) দপ্তরসমূহ শুধুমাত্র এক অপারেটরের অধীন প্লাটফর্মে নিবন্ধন করতে পারেন, কিন্তু সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সব কয়টি অপারেটরের প্ল্যাটফর্মে বিনামূল্যে নিবন্ধিত হতে পারেন।
৬) ক্রয়কারী দপ্তর যতবেশি সংখ্যক নিবন্ধিত হবে অপারেটরদের আয় ততো বেশি বৃদ্ধি পাবে (আমাদের দেশে মোবাইল অপারেটরদের মতো)। ফলে স্বভাবতই ৬টি অপারেটরের মধ্যে সবসময় বেশি সংখ্যক ক্রয়কারী দপ্তর নিবন্ধন করানোর জন্য একটি প্রতিযোগীতা বজায় থাকে; অর্থাৎ গ্রাহক আকর্ষনের জন্য তারা বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহন করে থাকেন।
৭) একজন ক্রয়কারী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একজন অপারেটরের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকেন এবং চুক্তিসময় শেষে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুন মেনে পুনরায় সংশ্লিষ্ট অপারেটরের সাথে বা অপারেটর বদল করে অন্য অপারেটরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারেন। ফলে অপারেটররা সবসময় তাদের নিবন্ধিত ব্যবহারকারীদের উন্নত সেবা প্রদানে সচেষ্ট থাকেন।
৮) পর্তুগালের ক্রয় সংক্রান্ত সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা দেখভালের দায়িত্ব IMPIC নামে (আমাদের সিপিটিইউ এর মতো) একটি সরকারী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত। পর্তুগালের ক্রয় সংক্রান্ত Policy Level-এর সকল কর্মকান্ড ও অন্যান্য দায়িত্বের পাশাপাশি তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন একটি দায়িত্ব হলো পর্তুগালে e-Procurement সেবা প্রদানকারী সকল অপারেটর তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে ও বিশ্বস্তভাবে পালন করছে কিনা তার দেখভাল করা।
৯) পর্তুগালে e-Procurement সেবা প্রদানকারী সকল অপারেটরকে তাদের ওয়েবভিত্তিক পোর্টালটি (তারা এটা e-Procurement প্ল্যাটফর্ম বলে থাকেন); IMPIC কর্তৃক জারীকৃত পর্তুগালের ক্রয় সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি, নীতিমালা ইত্যাদির আলোকে একটি আদর্শ মান (Standard) বজায় রেখে পরিচালনা করতে হয়। পোর্টালে বিভিন্ন আকর্ষনীয় Graphical Features ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি করে আরো উন্নত সেবা প্রদানের মাধ্যমে তারা তাদের e-Procurement প্ল্যাটফর্মটিকে অধিক সংখ্যক ব্যবহারকারীদের নিকট আকৃষ্ট করতে সবসময় সচেষ্ট থাকেন।
১০) আমার কাছে VOTRTAL এর e-Procurement প্ল্যাটফর্মটিকে আমাদের e-GP পোর্টালের তুলনায় খুবই আকর্ষনীয় (Attractive & Robust) মনে হয়েছে। আমাদের e-GP পোর্টালে দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অনেক তথ্য এবং সিদ্ধান্ত Manually প্রদান করতে হয়। ফলে এ ক্ষেত্রে Human Error এর কারণে ভূল Output/Result হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে। এছাড়া আমাদের মাঠ পর্যায়ের এলজিইডির কর্মকর্তাবৃন্দ যারা দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ/মূল্যায়ন পর্যায়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন; e-GP পোর্টালে দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি তাদের জন্য এখনও অনেক জটিল ও পরিশ্রমসাধ্য। কিন্তু পর্তূগালের e-Procurement সিস্টেমের ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো বিশেষ ধরনের বা জটিল (Special or Complex) ক্রয় ব্যতীত সাধারণ ধরনের ক্রয়কার্যের ক্ষেত্রে পুরো দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি-ই সম্পূর্ন System Generated (এখানে তারা তিন ধাপে দরপত্রদাতার Administrative, Technical & Financial মূল্যায়ন সম্পন্ন করেন)। ফলে দরপত্র আহবান হতে চুক্তি সম্পাদন অনেক কম সময়ে সম্পন্ন করা যায়। এছাড়া VOTRTAL এর e-Procurement প্ল্যাটফর্মটির প্রতিটি পৃষ্ঠায় Help Function সংযুক্ত দেখতে পেলাম, যার মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মটির একজন ব্যবহারকারী (ক্রয়কারী বা দরপত্রদাতা) কারো সহায়তা ছাড়াই Help Function-এর মাধ্যমে নিজের কাজটি করতে পারেন (এ ধরনের Facility আমাদের e-GP পোর্টালে নাই দেখে আমাদের এখানে Procurement বা e-GP সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের বেশ রমরমা অবস্হা; এ কারনে আমার তরফ থেকে আমাদের e-GP Software প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠানকে তিরষ্কার করবো না সাধুবাদ জানাব বুঝতে পারছি না)।
১১) পর্তূগালের সব সরকারী দপ্তরসমূহের চাহিদার ভিত্তিতে সাধারণ ও নৈমিত্তিক ধরনের সকল পণ্য ও সেবা (যেমন Stationary, Fuel, Cleaning, ইত্যাদি) ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের (Framework Agreement) মাধ্যমে ক্রয় করা হয়, যার ক্রয় প্রক্রিয়া e-Procurement সিস্টেমে সম্পন্ন হচ্ছে। এ ধরণের ক্রয় প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় ক্রয় ব্যবস্থাপনার (Centralized Procurement) মাধ্যমে করা হয়। কেন্দ্রীয় ক্রয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাধারণ ও নৈমিত্তিক ধরনের সকল পণ্য ও সেবা ক্রয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো সকল সরকারী দপ্তরসমূহে একই মানের পণ্য ও সেবা প্রদান নিশ্চিত করা; যা সকল সরকারী দপ্তরের কর্মচারীদের নিকট এই মূল্যবোধ আনয়ন করে যে Govt. Employee হিসাবে তারা একই মানের পণ্য ও সেবা ভোগ করছেন (অর্থাৎ কেউ Superiority Complex-এ আক্রান্ত হন না; সরকারী দপ্তরসমূহে সমতা আনয়নের একটি সুন্দর প্রচেষ্টা। এমনকি তারা সরকারী কর্মকর্তাদের দাপ্তিরক কাজে ব্যবহারের জন্য গাড়ী ক্রয় ও বরাদ্দের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যবস্হাপনা অনুসরণ করছেন, যাকে বলা হচ্ছে Fleet Management; এ বিষয়ে সম্ভব হলে পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখার আশা রাখি)। ESPAP নামে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয়ভাবে e-Procurement সিস্টেমে Framework Agreement-এর মাধ্যমে এ ধরনের ক্রয়কার্যের ক্ষেত্রে (Including Fleet Management) দরপত্র ব্যবস্থাপনার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। পরবর্তীতে Calloff Contracts-এর মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদন ও চুক্তির ব্যবস্থাপনা পণ্য ব্যবহারকারী/সেবা গ্রহনকারী সংশ্লিষ্ট ক্রয়কারীদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সুতরাং দরপত্র ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয়ভাবে করা হলেও চুক্তি সম্পাদন ও চুক্তির ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ন বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।
১২) পর্তূগালের সকল চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ (সরকারী বা বেসরকারী যে কোন ধরনের ক্রয় চুক্তি) অবশ্যই IMPIC এর নিয়ন্ত্রণাধীন একটিমাত্র ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত হয়; যেখানে Contract Agreement-এর দলিলসহ সম্পাদিত চুক্তি সংক্রান্ত সকল তথ্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
পরিশেষঃ পর্তূগালে ভ্রমণকালীন অর্জিত অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে আমাদের e-GP সিস্টেম, ক্রয় পদ্ধতি, ক্রয় প্রক্রিয়া, বিশেষ করে দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আরো অনেক উন্নতি করার সুযোগ রয়ে গেছে; যা আমাদের করতে হবে। আমাদের ক্রয় সংক্রান্ত আইন, বিধি থেকে শুরু করে বর্তমানে ব্যবহৃত e-GP সিস্টেমে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে অনেক সাধারন বিষয় রয়েছে, যা বাস্তবায়নকালীন সাধারন একজন ক্রয়কারীকে বা দরপত্রদাতাকে অধিকাংশ সময় অন্যের বা কোন কোন ক্ষেত্রে একজন Procurement Specialist-এরও পরামর্শ নিতে হয়; যা একেবারেই কাম্য নয়। e-GP সিস্টেম আমাদের দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে এখনও সহজ করেনি এবং দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় এখনও অনেক Confusion তৈরী হয়, যে বিষয়গুলি পর্তূগাল তাদের e-GP সিস্টেমের মাধ্যমে দূরীভূত করেছে। এছাড়া আমাদের ক্রয় প্রক্রিয়ায় ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট পদ্ধতি কেন্দ্রীয়ভাবে বা মন্ত্রণালয় পর্যায়ে চালু করা সম্ভব না হলেও অন্তত অধিদপ্তর পর্যায়ে চালু করার চেষ্টা আমরা করতেই পারি।
আশা করি উপস্হাপিত তথ্যগুলো সকলের উপকারে আসবে।