পোস্ট অফিস স্ক্যান্ডাল: পাবলিক প্রোকিউরমেন্টে ১টি আলোচিত ঘটনা
বিশ্বব্যাপী সরকারি ক্রয় বা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট খাতকে অনেক সময়ই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জন্য সমালোচিত হতে হয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসে যুক্তরাজ্যের পোস্ট অফিস স্ক্যান্ডালে এরকম বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান – যেখানে দুর্বল প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থাপনা জনগণের আস্থা ও অর্থ উভয়কেই ধ্বংস করেছে।
বিস্তারিত জানতে লগইন করুন।
ব্রিটিশ পোস্ট অফিস স্ক্যান্ডাল, যা হরাইজন আইটি স্ক্যান্ডাল নামেও পরিচিত, যুক্তরাজ্যের আইনি ও রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি চলমান ঘটনা। এই কেলেঙ্কারিতে পোস্ট অফিস হাজার হাজার নিরীহ সাব-পোস্টমাস্টারকে তাদের হিসাবে দৃশ্যমান আর্থিক ঘাটতির জন্য অভিযুক্ত ও মামলা করেছিল। এই ঘাটতিগুলি মূলত ফুজিৎসু (Fujitsu) দ্বারা তৈরি হরাইজন (Horizon) নামক একটি ত্রুটিপূর্ণ অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার সিস্টেমের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এই কেলেঙ্কারিকে ব্রিটিশ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিচারিক ত্রুটিগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
হরাইজন সফটওয়্যার, যা ১৯৯৯ সালে পোস্ট অফিস শাখায় চালু করা হয়েছিল, এটিতে “শত শত” বাগ বা ত্রুটি ছিল। ফুজিৎসু ১৯৯৯ সালের প্রথম দিকেই সফটওয়্যার বাগের কথা জানত, কিন্তু পোস্ট অফিস ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলা চলাকালীন এই ত্রুটিগুলির জ্ঞান প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়।
পোস্ট অফিসের চুক্তি অনুযায়ী, সাব-পোস্টমাস্টারদের তাদের শাখার যেকোনো আর্থিক ঘাটতির জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী থাকতে হতো এবং অবিলম্বে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হতো। হরাইজন সিস্টেমের ত্রুটি নিয়ে সাব-পোস্টমাস্টাররা অভিযোগ করলে, পোস্ট অফিস কর্তৃপক্ষ তাদের বলত যে এই সমস্যা কেবল তাদেরই হচ্ছে এবং সিস্টেমটি “শক্তিশালী” (robust)।
পোস্ট অফিস স্ক্যান্ডালের সাথে প্রকিউরমেন্ট বা সংগ্রহের (Procurement) সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং এটি এই কেলেঙ্কারির মূল ভিত্তিগুলির মধ্যে একটি।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ত্রুটিপূর্ণ প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হরাইজন (Horizon) সফটওয়্যারটি চালু হয়েছিল, যা পরবর্তী দুই দশক ধরে হাজার হাজার সাব-পোস্টমাস্টারের ভুল বিচারের কারণ হয়।
নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
- কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা হরাইজন আইটি সিস্টেমের সংগ্রহ (procurement) প্রক্রিয়াটিই ছিল প্রথম সমস্যার উৎস। হরাইজন সিস্টেমটি মূলত ১৯৯৬ সালে একটি প্রাইভেট ফাইন্যান্স ইনিশিয়েটিভ (PFI) চুক্তির অধীনে তৈরি হয়েছিল। এই চুক্তিটি পোস্ট অফিস এবং বেনিফিটস এজেন্সির সাথে কম্পিউটার কোম্পানি আইসিএল (ICL)-এর (যা পরে ফুজিৎসু দ্বারা অধিগ্রহণ করা হয়) মধ্যে হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে পোস্ট অফিস ফুজিৎসু কোম্পানি থেকে ‘হরাইজন’ নামক একটি আইটি সিস্টেম ক্রয় করে। কিন্তু প্রোকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ায় যথাযথ টেকনিক্যাল ভেরিফিকেশন কিংবা স্বাধীন অডিট না করেই এই সিস্টেমটি দ্রুত চালু করা হয়।
- এই বিপুল ব্যর্থতা সত্ত্বেও, পোস্ট অফিস সিস্টেমটিকে বাতিল না করে সেটিকে তার শাখাগুলির কাগজ-ভিত্তিক হিসাবকে ইলেকট্রনিক সিস্টেমে রূপান্তর করার জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি করা হয়েছিল পোস্ট অফিসের আইটি বিশেষজ্ঞদের better judgement উপেক্ষা করে।
- তদন্তে উঠে এসেছে যে সিস্টেমটি চালু হওয়ার আগেই এর সমস্যা সম্পর্কে জানা গিয়েছিল, যা একটি “শো-স্টপার” (show-stopper) হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
- পোস্ট অফিস হরাইজন প্রতিস্থাপনের জন্য একটি প্রধান প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিল, যেখানে আইবিএমকে (IBM) সরবরাহকারী হিসেবে নিয়োগের পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু প্রকল্পটি ২০১৫ সালে জটিলতার কারণে বাতিল হয়। পরবর্তীতে পোস্ট অফিস পরিচালকরা ফুজিৎসুতে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
- পোস্ট অফিস এখনো হরাইজন সিস্টেম ব্যবহার করছে, যদিও তারা ভবিষ্যতে নতুন সিস্টেমে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
সুতরাং, হরাইজন সফটওয়্যারটিকে দুর্বল প্রকিউরমেন্ট এবং কর্পোরেট সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছিল, যা ছিল এই বিচারিক ত্রুটির প্রাথমিক কারণ। এই সংগ্রহ প্রক্রিয়াটি দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা এবং ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সিস্টেমটিকে চালু ও বহাল রাখতে সাহায্য করেছিল।
এই PFI চুক্তিটি পরবর্তীতে “পাবলিক সেক্টরে সবচেয়ে বড় আইটি ব্যর্থতাগুলির মধ্যে একটি” হিসেবে গণ্য হয়েছিল, যার ফলে করদাতাদের প্রায় £৭০০ মিলিয়ন ক্ষতি হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যের পোস্ট অফিস স্ক্যান্ডাল প্রমাণ করে যে কেবল দুর্নীতিই নয়, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তিগত ত্রুটিও সমানভাবে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ফলাফল হয় মারাত্মক; সফটওয়্যারের ত্রুটির কারণে হাজার হাজার সাব–পোস্টমাস্টারের হিসাব গরমিল দেখাতে শুরু করে এবং তাদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনা হয়। প্রায় ৯০০ জন মানুষ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন এবং অনেকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে ধ্বংস হয়ে যান। বহু বছর পর প্রমাণিত হয় যে এটি ছিল সম্পূর্ণ সফটওয়্যারজনিত ত্রুটি এবং প্রকৃতপক্ষে তারা নির্দোষ ছিলেন। এই ঘটনাকে যুক্তরাজ্যের বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার মূল কারণ ছিল প্রোকিউরমেন্ট পর্যায়ে দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও পর্যবেক্ষণের অভাব।
প্রকিউরমেন্টে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে দুর্নীতি এবং অপচয় অবশ্যম্ভাবী। একইসাথে বড় আকারের প্রকল্প, বিশেষ করে প্রযুক্তি–নির্ভর প্রকল্পে, টেকনিক্যাল ডিউ ডিলিজেন্স ও স্বাধীন অডিট অপরিহার্য। ভেন্ডরের পারফরম্যান্স নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা থাকা চাই।
সবশেষে বলা যায়, পিরামিড স্ক্যান্ডাল ও পোস্ট অফিস স্ক্যান্ডাল বিশ্বকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—প্রোকিউরমেন্ট শুধু ক্রয়ের প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি। এই খাতের ব্যর্থতা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কেবল অর্থনীতি নয়, সাধারণ মানুষের জীবন ও আস্থাও।
এই লেখকের অন্যান্য লেখা

কখন ‘চুক্তি বাতিল প্রস্তাব পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের প্রয়োজন নেই
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গত ৪ঠা মে ২০২৫ ইং তারিখে “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫” এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট

‘চুক্তি বাতিল প্রস্তাব পর্যালোচনা কমিটি’ কি ? গঠন প্রণালী ও কাজ কি ?
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গত ৪ঠা মে ২০২৫ ইং তারিখে “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫” এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট

চলমান কোন চুক্তি গুলোতে পিপিআর-২০২৫ প্রয়োগ হবে আর কোনগুলোতে হবে না ?
সম্প্রতি গত ২৮/০৯/২০২৫ ইং তারিখে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০২৫ (পিপিআর ২০২৫) প্রকাশ করা হয়েছে। বিস্তারিত দেখুনঃ PPR-2025 সংক্রান্ত আলোচনা নতুন

বিধি ১৫৪ (পিপিআর-২০২৫) প্রয়োগ নিয়ে BPPA’র পরিপত্র জারী
সম্প্রতি গত ২৮/০৯/২০২৫ ইং তারিখে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০২৫ (পিপিআর ২০২৫) প্রকাশ করা হয়েছে। বিস্তারিত দেখুনঃ PPR-2025 সংক্রান্ত আলোচনা নতুন