শীর্ষ ৫% ঠিকাদারের কাজের হিস্যা প্রতি বছরই বাড়ছে, গড়ে প্রায় ৩০ ভাগ কাজের নিয়ন্ত্রণই এসব ঠিকাদারের হাতে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে টিআইবির ‘বাংলাদেশে ই-সরকারি ক্রয়: প্রতিযোগিতামূলক চর্চার প্রবণতার বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
এ গবেষণায় সরকারি ই-কেনাকাটায় প্রতিযোগিতার মাত্রা এবং একক দরপত্র পড়ার প্রবণতা চিহ্নিতকরণ; বাজার দখলের মাত্রা বিশ্লেষণ ও সরকারি ই-ক্রয়কার্যক্রমে প্রতিযোগিতা বাড়াতে করণীয় প্রস্তাব করার উদ্দেশ্যে ই-জিপি পোর্টালে থাকা ২০১২-২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত সকল ই-কার্যাদেশ (৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬ শত ৩৩টি) বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি ই-ক্রয়কার্যের ৯৬ ভাগের বেশি কেনাকাটা হয় দুটি ক্রয় পদ্ধতিতে। এর একটি উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি, অন্যটি সীমিত দরপত্র পদ্ধতি। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৫৩ ভাগ এবং ৪৩ ভাগ কেনাকাটা হয়েছে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে। ই-ক্রয়কার্যে সবার শীর্ষে স্থানীয় সরকার বিভাগ (মোট কার্যাদেশের ৪৪ শতাংশ এবং চুক্তি মূল্যের ৪১ শতাংশ)। ই- কেনাকাটার ৯৩ শতাংশ (মোট কার্যাদেশ) আর মূল্যের দিক থেকে ৯৭ শতাংশ মূলত ১০টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
ই-জিপি সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় দরপত্র পড়ার হারকে আপাত দৃষ্টিতে বাড়ালেও উন্মুক্ত দরপত্রপদ্ধতিতে দরপত্র জমার গড় মাত্র ৩.৫৩, যেখানে সীমিত দরপত্রপদ্ধতিতে এই গড় ৪৭.৭৫। ডেটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ১০ শতাংশের মূল্যসীমা সীমিত দরপত্র পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে, যেখানে কাজ পেতে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয় না, যেটি বাজারে প্রতিযোগীতার পরিবেশ বিনষ্ট করছে।
বিশ্লেষণ বলছে, ই-ক্রয় কার্যক্রমে ৪৬ ভাগ ক্ষেত্রে দরপত্র পড়ে ৪ টির কম। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এ হার ৬৫ ভাগ, যা ক্রয় প্রক্রিয়ায় কম মাত্রার প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত করে। শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারের কাজের হিস্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। গড়ে ২৬ ভাগের বেশি কাজ পাচ্ছে এসব বড় ঠিকাদার এবং নিচের দিকে থাকা ১০ শতাংশ ঠিকাদার পাচ্ছে মাত্র ২ থেকে ৩ ভাগ কাজ। সীমিত দরপত্রপদ্ধতি উন্মুক্ত দরপত্রপদ্ধতির চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। সার্বিকভাবে, ১৯ শতাংশ ক্ষেত্রে দরপত্র পড়েছে মাত্র একটি। অর্থাৎ প্রতি পাঁচটি দরপত্রের একটি একক দরপত্রের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এই হার ২৬ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি চারটির একটিই একক দরপত্র। সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে এই হার মাত্র ১১ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ই-ক্রয় কার্যের ৭০ শতাংশ এখনও পাচ্ছেন স্থানীয় ঠিকাদাররা। মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ পাচ্ছেন স্থানীয় নন এমন ঠিকাদার। দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ঠিকাদারের আধিপত্য ইঙ্গিত করে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য যোগসাজশ এবং গোষ্ঠীগত নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান।
বিশ্লেষণ বলছে, ই-ক্রয়প্রক্রিয়ায় একক দরপত্র পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। ২০১২ থেকে ২০২৩ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬০ হাজার ৬৯ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে একক দরপত্রের মাধ্যমে। ৯২টি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে একক দরপত্র পড়ার হার ৭৫ ভাগের বেশি এবং ৪ শত ১৬টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের ৭৫ ভাগই পেয়েছে একক দরপত্রের মাধ্যমে। ফেনী ও নোয়াখালী সবচে বেশি একক দরপত্র প্রবণ জেলা, এই দুই জেলায় প্রতি ২টি কার্যাদেশের একটি একক দরপত্র। এরপরেই রয়েছে কুমিল্লা ও নারায়নগঞ্জ, এই দুই জেলায় প্রতি তিনটির একটি কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে একক দরপত্রের মাধ্যমে। এই তালিকায় ঢাকা জেলার অবস্থান পঞ্চম। একক দরপত্র পড়ার হার ২৮ ভাগের বেশি। জেলাগুলোর মধ্যে একক দরপত্র সবচে কম পড়ে শরিয়তপুরে, প্রায় ৫ ভাগের কম; এরপরই রয়েছে ঠাকুরগাঁও এর অবস্থান, ৫.৬৮ শতাংশ। ছয়ভাগের বেশি একক দরপত্র পড়া জেলাগুলো হচ্ছে শেরপুর, বগুড়া, লালমনিরহাট, লক্ষীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নওগাঁ ও নাটোরে একক দরপত্র পড়ার হার ৭ ভাগের বেশি।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয় ই-জিপি’র ফলে ক্রয়প্রক্রিয়া সহজতর হয়েছে, প্রক্রিয়াসংক্রান্ত ব্যয় কমেছে, তবে দরপত্র জমা ও কার্যাদেশপ্রাপ্তীর ক্ষেত্রে বাজার দখল ও একচেটিয়াকরণ অব্যাহত রয়েছে এবং বাস্তবে তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। ফলে ই-জিপির মূল লক্ষ্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বনিম্ন মূল্য ও সর্বোচ্চমান নিশ্চিতের ক্ষেত্রে আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না।
সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় এক ধরনের বাজার দখল-প্রক্রিয়া মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। যদিও ই-জিপির মূল উদ্দেশ্যই ছিল, এই বাজার দখলকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা। তবে ক্রয়-পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম মেনেই ক্রয় সম্পন্ন হচ্ছে, তবে সার্বিকভাবে যেই মূল উদ্দেশ্য ছিল, সেটি আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। প্রতিযোগিতামূলক স্বচ্ছক্রয় এখনো পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ ক্রয় হয়েছে একক দরপত্র বা কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই। এ ধরনের পরিস্থিতি কোনোভাবেই জনগণের অর্থের সর্বোচ্চ মূল্যপ্রাপ্তী নিশ্চিত করতে পারে না। সরকারি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ত্রিমুখী যোগসাজশের ফলে একদিকে ই-জিপির প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ার ব্যাপকভাবে একচেটিয়াকরণ হচ্ছে। তবে, স্বদিচ্ছা থাকলে সরকারি তথ্যভাণ্ডারে বিদ্যমান তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ ক্রয়-প্রক্রিয়ার দুর্বলতা চিহ্নিত করে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারে।
বিশ্লেষণের আলোকে ই-জিপিকে যোগসাজশ মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক করার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য টিআইবি ৬টি সুপারিশ উত্থাপন করছেঃ
-
- ই-ইজিপির আওতার বাইরে থাকা উচ্চ চুক্তিমূল্যের সকল দরপত্র দ্রুততার সাথে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় আনতে হবে;
- সরকারি ক্রয়ে প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে উন্মুক্ত দরপত্রপদ্ধতি এবং সীমিত দরপত্রপদ্ধতিতে আরোপিত মূল্যসীমা প্রত্যাহার করতে হবে;
- সীমিত দরপত্রপদ্ধতি অনুসরণের বর্তমান ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজিয়ে সরকারি ক্রয় আইন ২০০৬ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে;
- বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিতে এবং সম্ভাব্য যোগসাজস বন্ধে একক দরপত্র প্রবণ ক্রয় অফিসগুলোকে নজরদারির ভেতর আনতে হবে;
- সকল ক্রয় কর্তৃপক্ষ এবং সিপিটিইউ সরকারি ক্রয়ে প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে;
- একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিপূর্ণ, পক্ষপাতহীন, প্রতিযোগিতামূলক এবং সর্বোপরি দূর্নীতিমুক্ত সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ই-জিপির মাধ্যমে তৈরি হওয়া সুযোগ কাজে লাগাতে উপাত্ত নির্ভর বিশ্লেষণ এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে জোরদার করার মাধ্যমে পুরো ক্রয় ব্যবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।