এই যে প্রকল্প পরিচালকের ওপর হামলা হলো, এ ধরনের হামলার ঘটনা তো অতীতেও দেখা গেছে। সেসব ক্ষেত্রে কি যথাযথ বিচার পরিলক্ষিত হয়েছে ? দৃষ্টান্তমূলক কিছু হয়েছে কি ? তো যেখানে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেখা যায়নি, সেখানে এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। আমরা অবাক হচ্ছি কেন ?
কয়েক বছর আগে পরিচিত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছোট ভাই একবার সরকারি চাকরিতে যোগদানের পূর্বে পরামর্শ নেয়ার জন্য জানতে চেয়েছিল “ভাইয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় সরকারী চাকরি করতে পারবো তো ? ঠিকাদার সামলাইতে পারবো তো ? পেপার পত্রিকায় তো অনেক কিছু দেখি। অনেক ঝামেলার ব্যাপার স্যাপার নাকি আছে।“
কি আর বলবো তখন ? আমার কি বলা উচিত ? দেশের চাকরি বাকরির যে অবস্থা !!! দেশে থাকলে এগুলো নিয়েই চলতে হবে। বললাম, আরে সমস্যা নাই, জয়েন কর। আল্লাহ ভরসা।
এবার বর্তমানে আসি।
এ যাবতকালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে এলজিইডির প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীকে গত ১৪ আগস্ট ২০২২ তারিখে স্থানীয় সরকার বিভাগ নিজ উদ্যোগেই নিয়োগ দেয়। যতদূর জানা যায় এর জন্য প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানী কোন তদবির করেন নি যা কিনা রীতিমতো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কাগজপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাইসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উপযুক্ত ঠিকাদারদের কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছিলেন। এতে গোঁজামিলের কাগজপত্র দিয়ে ইতঃপূর্বে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নেওয়া একটি চক্র ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। চক্রটি কয়েকদিন আগে করপোরেশনে অস্ত্রের মহড়াও দেয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৯ জানুযারি ২০২৩ তারিখে কক্ষ ভাঙচুরসহ তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, যা কোনোমতেই বরদাশত করা যায় না।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (IEB) এই ঘটনায় সাথে সাথেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। এলজিইডি থেকে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। সিআইপিএস (CIPS) বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ হতে এ ধরনের ঘটনায় ক্ষোভ ও তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ঘটনার পরদিনই সারা দেশে একযোগে মানববন্ধন হয়েছে। মানববন্ধনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বক্তরা সন্ত্রাসী কায়দায় আক্রমণকারিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করেছেন। সরকারি ক্রয়কার্যে জড়িতদের যথাযথভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের স্বার্থে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সে লক্ষ্যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বক্তারা। এই ঘটনার পর বিস্মিত হয়েছেন সাধারণ মানুষ।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীকে একজন সৎ ও নির্ভীক কর্মকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করে তার ওপর হামলাকে ‘পরিকল্পিত’ বলে অভিযোগ করেছে। কোনো মহল তার প্রতি বিরাগভাজন হতে পারে বলে তাদের ধারণা। প্রকল্প পরিচালককে মারধরের ঘটনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সংযুক্তঃ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ঘটনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
এখন, গণমাধ্যমে উঠে আসা এসব ঘটনাকেও তদন্তে নিয়ে আসা বিশেষ প্রয়োজন। একজন সরকারি কর্মকর্তা যিনি আইন প্রয়োগ করবেন, দেশের উন্নয়ন কাজকে নিরাপদ নির্বিঘ্ন করবেন, অথচ, তিনি নিজেই তো নিরাপদ নন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এই ঘটনার বিচারের দাবি জানাচ্ছেন।
সংযুক্তঃ ঠিকাদারেরা এই দুঃসাহস পান কীভাবে ?
প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানী একজন সৎ, যোগ্য, কর্মঠ এবং সরকারি ক্রয় বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী বলে তার সহকর্মীদের কাছে জানা গেছে। সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে তার দক্ষতা ও জ্ঞানের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমেও তিনি সব মহলের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তার উপর এমন আঘাত ভালো কাজে অনেকের মনোবলই ভেঙে দিতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্ট জনেরা।
সরকারি দায়িত্ব পালনকালে কোন কর্মকর্তা এভাবে কেন হেনস্থা হোন তা সবারই বোধগোম্য। তারপরও, এভাবে একজন প্রকল্প পরিচালক হেনস্থা হলে রাষ্ট্রের কিছু যায় আসে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে এ ধরনের ঘটনায় যে একজন ব্যক্তি এবং তার পারিবারিক জীবনে প্রভাব পড়ে তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীর একটি পরিবার রয়েছে। তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যগন এখন কি পরিমাণ মানসিক ট্রমার ভেতর রয়েছেন তা কি আমরা ভেবে দেখেছি। একজন প্রকল্প পরিচালক কি কখনো ভেবেছেন এই স্বাধীন দেশে সরকারি দায়িত্ব পালনে তাকে ও তার পরিবারকে এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে! সততা ও দায়িত্বশীলতার পুরস্কার কি এ দেশে শুধুই হেনস্থা হওয়া।
সংযুক্তঃ সেই প্রকল্প পরিচালক আর চসিকে ফিরতে চান না
বিদ্যমান ক্রয় আইনে মারামারি বা জবরদস্তি করা দরপত্রদাতা বা ঠিকাদার যেই হোক তা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ অনুযায়ি মারামারির ঘটনার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ চুক্তি বাতিল করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ১ বৎসর অথবা অনধিক ২ বৎসরের জন্য সকল ক্রয়কারীর ক্রয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করতে পারবে।
এছাড়াও, সরকারি দায়িত্ব পালনকালে একজন প্রকৌশলীকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতি বা হুমকির মাধ্যমে কোন বেআইনী কাজ করতে বাধ্য করার চেষ্টা বা আইনতঃ করণীয় কাজে বিঘ্ন সৃষ্টিসহ আবেদন, দরপত্র বা প্রস্তাব দাখিলে বাধা প্রদান দণ্ডবিধি (Penal Code) এর ধারা ৫০৩ অনুযায়ী অপরাধ এবং সেক্ষেত্রে উক্ত দন্ড বিধির ধারা ৫০৬ অনুযায়ী তা শাস্তিযোগ্য।
কিন্তু এসব ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে আমরা কি দেখি। শুধু প্রকল্প পরিচালকই নন, স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও চক্রের মাধ্যমে নানাভাবে নিপীড়ন-নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকেন সারা দেশের মাঠপর্যায়ের সরকারি ক্রয় কর্মকর্তারা। কিছু ঘটনায় মামলা হলেও তার বিচারকার্য চলে মন্থর গতিতে। ফলে অপরাধীরা আরেকটি ঘটনা ঘটানোর সাহস পায়। তাই এ ধরনের ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করাও বিশেষ প্রয়োজন। যেগুলো স্পর্শকাতর ঘটনা, সেগুলোকে সাধারণ মামলার তালিকায় না এনে, আলাদা তালিকায় এনে এই বিচারগুলো আগে করা উচিত। এই ধরনের বিচারগুলোর কাজ দ্রুত করা উচিত। আগের ঘটনাগুলোতে ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই ঘটনা।
পাশাপাশি সরকারি দপ্তরগুলোর এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠন গুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন। যাদের গতিবিধি ও কাজকর্ম আপত্তিকর, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘটনা ঘটলে নয়, ঘটার আগেই এই ব্যবস্থা করতে হবে। ১২ মাসই এটা করতে হবে।
ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। বরং বিগত কয়েক বছরে সরকারি ক্রয় কর্মকর্তাদের উপর এরকম হামলার ঘটনা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তা রীতিমতো সদর দপ্তরের অফিস কক্ষে চলে এসেছে।
এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং বৃহত্তর সমাজের, বিশেষ করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অবাধ অথবা আংশিক প্রশ্রয়ের একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এদের কেউ কেউ যখন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পদপদবি ধারণ করে আস্টম্ফালন করে বেড়ায়, তখন তা নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায় না। অপরাধ বা অঘটন ঘটলেই তড়িঘড়ি করে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া যেন এক নতুন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বাধা দিলে ক্রয় কর্মকর্তাদের ট্রান্সফার পোস্টিং-ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। যদিও এই ঘটনায় মামলা হওয়ায় এখন পর্যন্ত চার জন গ্রপ্তার হয়েছে মর্মে পত্র-পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও তিন সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিটি করপোরেশন। তিন দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও এখনও তা প্রকাশ করা হয় নি। কাজেই এই ঘটনার সর্বশেষ পরিনতি কি হবে তা নিয়ে আশান্বিত হবার খুব বেশি উদাহরন নেই। শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী মহলের বিরাগভাগজন হওয়ায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী দেলোয়ার সাহেবের খুন এখন অনেক আগের কথা। সবাই ভুলতে বসেছে। বিচারের বাণী আদালতের কাঠ গড়ায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
সংযুক্তঃ ঘুষ ও অনৈতিক সুবিধা না নেওয়ায় খুন হন প্রকৌশলী দেলোয়ার
বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা এখনও অনেক ব্যাপক। সরকারি ক্রয় কার্যক্রমেও যে কিছু দুর্নাম রয়েছে, তা বোধ হয় অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে, সব পেশার মতো, এখানেও সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত নন এবং চারপাশের দুর্নীতির মধ্যে অনেকেই সততাকে আঁকড়ে থাকেন শেষ পর্যন্ত। প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানী এই অল্প কিছু ব্যতিক্রমের মধ্যে একজন। তাকে অভয় দেয়া, নিরাপত্তা দেয়া, পুরষ্কৃত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে তার জন্য রাষ্ট্রের প্রস্তুতি কতটুকু ? রাষ্ট্র কি এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে প্রস্তুতি নেবে ?