আতিকুল ইসলাম কাইফ, প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট
সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়। ক্রয় বিধিমালার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রভাব, যোগসাজশ ও সিন্ডিকেট, গোপনীয়তা লংঘন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, ইত্যাদির বিভিন্ন মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের একাংশ দুর্নীতির নতুন নতুন পথ খুঁজে নেয়। আবার, সরকারি ক্রয়ে ই-জিপি (ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) প্রবর্তনের ফলে ক্রয় প্রক্রিয়া সহজতর হলেও দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অন্যান্য সমস্যা এখনও দূর করা সম্ভব হয়নি।
সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে বড় এবং প্রযুক্তিগত পণ্য অর্থাৎ “পণ্য সরবরাহ (Goods Procurement)” ক্রয়ের ক্ষেত্রে, দুর্নীতির সম্ভাবনা ও প্রতিরোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পণ্য সরবরাহ ক্রয় প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে দুর্নীতির সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা রোধ করার জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
আমি দীর্ঘ ১০ বছর যাবত Goods Procurement নিয়ে কাজ করছি। বিশেষ করে চট্রগ্রাম ও মংলা বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিং এর গ্যান্টি ক্রেন এবং ড্রেজার সরবরাহ; বাংলাদেশ আর্মি, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনি তে ব্র্যান্ড নিউ SUV জীপ সরবরাহ; ফায়ার সার্ভিস (এফ এস সিডি) তে টিটিএল, ওয়াটার টেন্ডার/ফায়ার ট্রাক সরবরাহ; এলজিডিতে ভ্যাকুয়াম ট্রাক, গারভেজ ট্রাক, বুলডোজার, এক্সক্যাভেটর, রোড রোলার সরবরাহ; উত্তর এবং দক্ষিত সিটি কর্পোরেশন এবং চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে এ বিভিন্ন জীপ, জেনারেটর, বিভিন্ন স্পেশাল ভেহিক্যাল সরবরাহ, ইত্যাদি সহ সরকারি বেসরকারি অসংখ্য পণ্য ও পণ্য সংশ্লিষ্ট ক্রয়ে সরাসরি যুক্ত থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। অনেক ভাল ভাল অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তার আলোকেই আজকে আমার কিছু মতামত তুলে ধরবো।
এখানে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় পণ্য সরবরাহ (Goods Procurement) এর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য দুর্নীতির উৎস এবং তাদের প্রতিকার সম্পর্কে আমার কিছু মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরা হলো:
১. প্রয়োজনীয়তার সনাক্তকরণ ও স্পেসিফিকেশন
দুর্নীতি সম্ভাবনা: কারিগরি বিনির্দেশ (Technical Specification) প্রস্তুতির সময় পক্ষপাতমূলক বৈশিষ্ট সন্নিবেশ করা যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সরবরাহকারীরকে সুবিধা প্রদান করে।
প্রতিকার:
-
- বাজার গবেষণা: বাজার গবেষণা করে সর্বশেষ প্রযুক্তি এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী স্পেসিফিকেশন নির্ধারণ করুন।
- স্বাধীন পরামর্শ: ক্রয়কারীর পর্যাপ্ত কারিগরী দক্ষতা না থাকলে স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করুন এবং প্রস্তাবিত স্পেসিফিকেশনগুলি তাদের পর্যালোচনা অনুযায়ি প্রস্তুত করুন।
২. দরপত্র প্রস্তুতি ও বিজ্ঞপ্তি
দুর্নীতি সম্ভাবনা: দরপত্র দলিল (Tender Document) এর Qualification Criteria তে পক্ষপাতমূলক শর্ত রাখা যা কেবল নির্দিষ্ট সরবরাহকারিকেই উপকৃত করে। কারিগরি বিনির্দেশ দরপত্রদাতাগণের নিকট সহজে বোধগম্য করে উপস্থাপন না করা।
প্রতিকার:
-
- স্বচ্ছ শর্তাবলী: দরপত্রের সকল শর্ত ও টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন স্পষ্ট ও সহজে বোধগম্য ভাবে সন্নিবেশ করুন।
- সহসলভ্য করা: দরপত্র বিজ্ঞপ্তি এবং অন্যান্য তথ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করুন যাতে সকল প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সম্ভব হয়।
- প্রি-বিড মিটিং: প্রি-বিড মিটিং কে উৎসাহিত করা, প্রি-বিড মিটিং এর আলোচনাকে গূরুত্ব দেয়া এবং সে অনুযায়ি নিরপেক্ষ ব্যবস্থা নেয়া।
৩. দরপত্র প্রাপ্তি ও মূল্যায়ন
দুর্নীতি সম্ভাবনা: প্রস্তাবনা মূল্যায়নের সময় পক্ষপাতমূলক আচরণ বা দুর্নীতির কারণে একটি নির্দিষ্ট প্রস্তাবনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
প্রতিকার:
-
-
- মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম: দরপত্র মূল্যায়নের জন্য একটি বৈচিত্র্যময় ও অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করুন যাতে বিভিন্ন অভিজ্ঞ ও দক্ষতা সমপন্ন সদস্যরা অন্তর্ভূক্ত থাকে। একই কমিটি যেন বার বার মূল্যায়নে যুক্ত না থাকে।
- প্রতিষ্ঠিত ক্রাইটেরিয়া: মূল্যায়নের জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করুন এবং তার আগাম ঘোষণা থাকতে হবে। দরপত্র মূল্যায়নে মূখ্য বিচ্যুতি (Major Deviation) এবং গৌণ বিচ্যুতি (Minor Deviation) এর বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাক্ষ্যা থাকতে হবে।
-
৪. চুক্তি প্রদান ও বাস্তবায়ন
দুর্নীতি সম্ভাবনা: চুক্তির সময় শর্তাবলী পরিবর্তন করে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করা এবং ত্রুটিযুক্ত পণ্য গ্রহণ করা গোপনে সুবিধা দেয়া।
প্রতিকার:
-
- চুক্তি শর্তাবলী ও দলিল প্রকাশ করা: চুক্তির শর্তাবলী, মূল্য এবং সময়সীমা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন এবং সম্মতির জন্য সমস্ত পক্ষের কাছে উপস্থাপন করুন। চুক্তির পর তা প্রকাশ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- চুক্তি ব্যবস্থাপনা: চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করুন এবং কার্যকরী ফলাফল নিশ্চিত করতে মনিটরিং টিম গঠন করুন।
৫. মান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত যাচাই
দুর্নীতি সম্ভাবনা: কম মানের পণ্য সরবরাহ করা হলেও অস্বীকার করা বা ভুল ফলাফল উপস্থাপন করা। গোপনে যোগসাজশ করা।
প্রতিকার:
-
- কোয়ালিটি অডিট: পণ্য সরবরাহের পর একটি সম্পূর্ণ কোয়ালিটি অডিট পরিচালনা করুন এবং মানের নিশ্চয়তা প্রাপ্ত করুন।
- পাইলট টেস্টিং: পণ্য গ্রহণের আগে একটি পাইলট টেস্টিং পরিচালনা করে বাস্তবিক মান যাচাই করুন।
৬. অভিযোগ ও প্রতিকার
দুর্নীতি সম্ভাবনা: অভিযোগ করার পরও সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া বা অভিযোগের তদন্ত সঠিকভাবে না করা। ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রভাব, যোগসাজশ ও সিন্ডিকেট, ইত্যাদির মাধ্যমে অভিযোগকারিকে হয়রানি করা বা অভিযোগ আমলে না নেয়া।
প্রতিকার:
-
- অভিযোগ ব্যবস্থা: একটি স্বচ্ছ এবং কার্যকরী অভিযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ ও অংশগ্রহণকারীদের অভিযোগ গ্রহণ করুন।
- তদন্ত ও প্রতিকার: অভিযোগের দ্রুত তদন্ত এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। নিশ্চিত করুন যে তদন্তের ফলাফল সবার কাছে প্রকাশ করা হয়।
৭. প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা
দুর্নীতি সম্ভাবনা: প্রক্রিয়ায় জড়িত কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব থাকলে দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রতিকার:
-
- প্রশিক্ষণ কর্মশালা: সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করুন যাতে তারা দুর্নীতি ও পক্ষপাতমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সচেতন থাকে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করুন।
- পুরষ্কৃত করা: সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের পুরষ্কার এবং অসৎ কর্মকর্তাদের তিরষ্কারের ব্যবস্থা করুন।
৮. মনিটরিং ও অডিট
দুর্নীতি সম্ভাবনা: সময়মতো পর্যাপ্ত মনিটরিং এবং অডিটের অভাবে দুর্নীতি বা পক্ষপাতমূলক আচরণ ধরতে না পারা।
প্রতিকার:
-
- স্বাধীন অডিট: একটি স্বতন্ত্র অডিট টিম গঠন করুন যা নিয়মিতভাবে প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করবে।
- স্টেকহোল্ডার এনগেজমেন্ট: স্থানীয় সম্প্রদায় এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এবং ফিডব্যাক সংগ্রহ করুন।
পরিশেষঃ
উপরের সাম্ভাব্য উৎসগুলির বাইরেও আরও অনেক খাত বা ধাপ আছে যেসব জায়গাতেও নজর দেয়া দরকার। অভিজ্ঞজনরা এ বিষয়ে আরও পয়েন্ট যুক্ত করতে পারবেন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
তারপরও, উপরের সুপারিশকৃত পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে সরকারি ক্রয়ে পণ্য সরবরাহ (Goods Procurement) এর মতো জটিল ক্রয় প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা অনেকটাই সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। এতে করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা সহ সর্বোপরি জনসেবায় উন্নতি ঘটবে বলে আশা করাই যায়।