এলজিইডিতে Procurement Post Review প্রতিবেদনের উপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) অদ্য ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ইং তারিখে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পের ক্রয় কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য একটি ক্রয় প্রক্রিয়া-উত্তর পুনরীক্ষণ (Procurement Post Review) কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট কর্তৃপক্ষ (বিপিপিএ) এর অধীনে পরিচালিত এই পর্যালোচনায় মোট ৩,৩৬০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ৩০টি চুক্তির Procurement Post Review করা হয়েছে।
কর্মশালায় বিপিপিএ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মির্জা আশফাকুর রহমান, এলজিইডি’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (অতিঃ দায়িত্ব) মোঃ আনোয়ার হোসেন ছাড়াও এলজিইডি’র অনেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক, বিভিন্ন প্রকিউরমেন্ট প্রফেশনালগন উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালায় মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন কাজী জাহাঙ্গীর আলম।
সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (CPTU) ২০০২ সালে আইএমইডি-র একটি ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (BPPA) হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়েছে। PPA-2006 এর ধারা ২৪ এবং PPR-2008 এর বিধি ৪৬ অনুযায়ী BPPA-কে PPA/PPR এর অগ্রগতি/কমপ্লায়েন্স পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এলজিইডি গ্রামীণ অবকাঠামো ও পরিবহনের উন্নয়নে পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত। আজকে পর্যন্ত ই-জিপি সিস্টেমের প্রায় ২৫ ভাগ দরপত্র শুধুমাত্র এলজিইডি’র বিভিন্ন ক্রয়কারির মাধ্যমে আহবান করা হয়েছে। এলজিইডি’র মতো বৃহৎ ক্ষেত্রে ক্রয়চুক্তি বাস্তবায়নে এবং সরকারি ক্রয় বিধিমালা, ২০০৮ প্রতিপালন ও ই-জিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সকলের অভিজ্ঞতা ও মতামত জানা জরুরি। সে লক্ষ্যেই আজকের এই কর্মশালা বলে বিপিপিএ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মির্জা আশফাকুর রহমান মত ব্যক্ত করেন।
এলজিইডি’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (অতিঃ দায়িত্ব) মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন Procurement Post Review এর মাধ্যমে সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা, দক্ষতা, জবাবদিহিতা এবং Value for Money নিশ্চিত করার প্রেক্ষাপট থেকে এই ধরনের পর্যালোচনা প্রয়োজন আছে।
পর্যালোচনায় Procurement Post Review এর মূল উদ্দেশ্যগুলো বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে:
- প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়া ও চুক্তি PPA/PPR অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা যাচাই করা।
- উপযুক্ত স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্টস (STD) অনুসরণ করা হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা।
- স্বচ্ছতা, দক্ষতা, কার্যকারিতা এবং প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা তা মূল্যায়ন করা।
- Value for Money কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা নিরূপণ করা।
- প্রকিউরমেন্টে এলজিইডি বা ক্রয়কারিদের (PE) সক্ষমতা মূল্যায়ন করা।
- প্রকিউরমেন্ট কার্যক্রমে দূর্বলতা এবং উন্নতির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা।
পর্যালোচনার পরিধি ও পদ্ধতি
এই পর্যালোচনার আওতায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ কোটি বা তার বেশি ব্যয় করেছে এমন ক্রয়কারি বিবেচনা করা হয়েছে। ১৩ জন স্বতন্ত্র পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছিল এই কাজের জন্য। পরামর্শকরা ৫টি প্রকল্প থেকে ৩০টি চুক্তি পর্যালোচনা করেছেন (প্রতিটি থেকে ৬টি করে)। BPPA নির্দেশিকা অনুযায়ী বিস্তারিত Terms of References নির্ধারণ করা হয়েছিল।
পর্যালোচনার পদ্ধতিটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়েছে:
ধাপ-১: ইন্সেপশন রিপোর্ট জমা দিয়ে এলজিইডি ও BPPA এর সাথে সমন্বয় স্থাপন।
ধাপ-২: ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫টি PE থেকে সম্পাদিত চুক্তির তালিকা সংগ্রহ।
ধাপ-৩: BPPA নির্দেশিকা অনুযায়ী ৩০টি নমুনা চুক্তি নির্বাচন।
ধাপ-৪: ক্ষেত্র পরিদর্শন এবং নির্দিষ্ট ফরম্যাট অনুযায়ী নথি পর্যালোচনা, তথ্য সংগ্রহ, প্রকিউরমেন্ট আইটেমের প্রোফাইলিং, ফলাফল সংগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট ক্রয়কারি দপ্তরসমূহ পরিদর্শন।
ধাপ-৫: তথ্য প্রক্রিয়াকরণ (সংকলন, বিশ্লেষণ, যাচাই)।
ধাপ-৬: অন্তর্বর্তীকালীন অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি ও উপস্থাপন।
ধাপ-৭: খসড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি ও কর্মশালায় উপস্থাপন (২৮ এপ্রিল ২০২৫)।
ধাপ-৮: কর্মশালার মন্তব্য ও ফিডব্যাক সংগ্রহ এবং অন্তর্ভুক্তকরণ।
পর্যালোচনার পরবর্তী ধাপগুলো হলো:
ধাপ-৯: চূড়ান্ত প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণ ও BPPA-তে জমা।
নির্বাচিত ৩০টি চুক্তির মধ্যে ১৬টি কাজ (Works), ১১টি পণ্য (Goods) এবং ৩টি সেবার (Service) চুক্তি ছিল। ক্রয় পদ্ধতির মধ্যে OTM ৪৭%, RFQ ২০%, LTM ১৩%, OSTETM ১০%, ICS ৭% এবং QCBS ৩% ছিল। চুক্তির সংখ্যার ভিত্তিতে ৬৩% ই-জিপি (e-GP) এবং ৩৭% ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হয়েছে, তবে চুক্তি মূল্যের ভিত্তিতে ৮৩.৫% ই-জিপি এবং ১৬.৫% ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সম্পাদিত হয়েছে।
পর্যালোচনায় প্রকিউরমেন্ট কার্যক্রমের উপর Strengths এবং Weaknesses চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অনেকগুলো সুপারিশমালা (Recommendations) প্রদান করা হয়েছে। এগুলোর উপর উপস্থিত কর্মকর্তাগন প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী প্রাণবন্ত উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ
পর্যালোচনায় ক্রয় কার্যক্রমে, বিশেষ করে স্বচ্ছতা রক্ষায়, ভ্যালু ফর মানি অর্জনে এবং নিয়মকানুন মেনে চলার ক্ষেত্রে LGED-এর দক্ষতা প্রতিফলিত হয়েছে। তবে, প্রতিবেদনে মানবসম্পদ ঘাটতির মতো পদ্ধতিগত দুর্বলতাগুলিও প্রকাশ পেয়েছে।
LGED-এর মতো বৃহৎ অধিদপ্তরেও প্রকৌশলী পদে প্রায় ৩৬% পদ শূণ্য পাওয়া গিয়েছে যে পদের কর্মকর্তারাই মূলতঃ ক্রয় কার্যক্রম এবং চুক্তি বাস্তবায়নের সাথে সরাসরি জড়িত। দীর্ঘকালব্যাপী এরকম জনবল ঘাটতি যথাক্রমে চুক্তি ব্যবস্থাপনা এবং প্রকল্প তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে চুক্তি বা প্রকল্প সমাপ্তিকরণে বিলম্ব ঘটে এবং অর্থের অপচয়ের মাধ্যমে মূল্যবান সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিশেষঃ
সুতরাং, প্রকিউরমেন্ট পোস্ট রিভিউ হলো সরকারি ক্রয়ের স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং কার্যকরিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এটি কেবল নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে কিনা তা যাচাই করে না, বরং পুরো ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে এবং উন্নতির পথ দেখায়, যা শেষ পর্যন্ত জনগণের অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ক্রয়ে বার্ষিক ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। এই বিশাল ব্যয়ে কোন অপচয় যাতে না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের যথাযথ ও সময়োপযোগী বাস্তবায়নের উপর জোর দিয়েছে। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৫০০ প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদি এই প্রকল্পগুলির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে এর বিরাট ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই প্রতিবেদনটির মাধ্যমে সবাই স্বীকার করেছে যে অন্যান্য সরকারি দপ্তর ও প্রকল্পগুলিতেও নিয়মিত এরকম ক্রয় নিরীক্ষার গুরুত্ব আছে।

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

সিএজি কার্যালয়ে অডিট সংক্রান্ত বিশেষ সেবা কার্যক্রম চলছে
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়ের ৫২তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে চার দিনব্যাপী (১২-১৫ মে, ২০২৫) সারা বাংলাদেশের সকল নিরীক্ষা ও

“Significantly low price)” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

“ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট বা রেট কন্ট্রাক্ট” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি