পাল্টা শুল্ক বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনের উপর আঘাত

যে দেশ আমেরিকার পণ্যে যতটা শুল্ক চাপিয়ে থাকে, ২ এপ্রিল থেকে সেই দেশের পণ্যে পাল্টা তার উপযুক্ত হারে শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই ঘোষণা আন্তর্জাতিক বানিজ্যে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রীতিমতো বোমাবর্ষণের শামিল। এর প্রধান কারণ হলো, শুল্ক আরোপের মাধ্যমে পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যায়, যা কোম্পানিগুলোকে তাদের সাপ্লাই চেইন এবং উৎপাদন কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ফলে পণ্যের উৎসের উপর ভিত্তি করে বিশ্ব বাণিজ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের একটি প্রধান প্রভাব হলো বিভিন্ন কোম্পানি তাদের উৎপাদন এবং সরবরাহ চেইনকে চীনের বাইরে অন্যান্য দেশে বিস্তৃত করতে শুরু করেছে। এর ফলে, ভিয়েতনাম, ভারত, মেক্সিকো এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও জোরালো হতে পারে, যার ফলে বাণিজ্যের উৎস একটি নির্দিষ্ট দেশের উপর নির্ভরশীল না থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক (reciprocal tariffs) আরোপের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে (supply chain) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে অনেকেই এখন আশংকা করছেন।
বহুপাক্ষিকতার বিরোধিতা (Opposition to Multilateralism)
আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ (WTO) বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির সমর্থক ছিল। এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে। ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির অধীনে, আমেরিকা অনেক বহুপাক্ষিক চুক্তি থেকে সরে আসে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির উপর জোর দেয়। এটি বহুপাক্ষিকতার মূলনীতির বিরোধী।
শুল্ক আরোপের কারণে বিভিন্ন দেশ আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি (Regional Trade Agreements – RTAs) এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (Free Trade Agreements – FTAs) দিকে ঝুঁকতে পারে। এর মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো একে অপরের সাথে শুল্কমুক্ত বা কম শুল্কে বাণিজ্য করতে পারবে, যা পণ্যের উৎসের ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাকে উৎসাহিত করবে। যেমন, আমেরিকা হয়তো উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারে।
সুরক্ষাবাদ (Protectionism)
মুক্ত বাজার অর্থনীতির মূলনীতি হলো অবাধ বাণিজ্য এবং শুল্ক ও অন্যান্য বাণিজ্য বাধা দূর করা। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ সুরক্ষাবাদের একটি উদাহরণ, যেখানে দেশীয় শিল্পকে বিদেশি প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমদানি পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করা হয়। এটি মুক্ত বাণিজ্যের ধারণার বিপরীত, যেখানে সরকার বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করে না এবং বাজার তার নিজের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে।
কিছু দেশ শুল্ক আরোপকে একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে পারে। এর ফলে, কোম্পানিগুলো আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের দেশেই পণ্য উৎপাদনে মনোযোগ দিতে পারে। এটি পণ্যের উৎসের ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে, যেখানে স্থানীয় উৎপাদন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে।
প্রযুক্তি ও অটোমেশনের প্রভাব
শুল্ক আরোপের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়লে, কোম্পানিগুলো হয়তো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আরও বেশি প্রযুক্তি ও অটোমেশন ব্যবহার করতে উৎসাহিত হবে। এর ফলে, শ্রমিকনির্ভর দেশগুলোর পরিবর্তে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলো উৎপাদনে এগিয়ে থাকতে পারে, যা পণ্যের উৎসের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনবে।
ভোক্তাদের পছন্দ ও ব্র্যান্ডের গুরুত্ব (Consumer Preferences and Brand Loyalty)
শুল্ক আরোপের কারণে পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তারা হয়তো বিকল্প উৎসের বা দেশীয় পণ্যের দিকে ঝুঁকতে পারে। তবে, শক্তিশালী ব্র্যান্ড এবং ভোক্তাদের পছন্দের ক্ষেত্রে পণ্যের উৎস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, ভোক্তারা বেশি দাম দিয়েও নির্দিষ্ট দেশের পণ্য কিনতে আগ্রহী থাকতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও পণ্যের উৎসের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। দুটি দেশের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বাণিজ্য যুদ্ধ চললে, কোম্পানিগুলো সেই দেশ থেকে পণ্য আমদানি বা রপ্তানি করতে দ্বিধা বোধ করতে পারে এবং বিকল্প উৎস খুঁজতে পারে।
মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় বাণিজ্য যুদ্ধ কাম্য নয়। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের কারণে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই বাণিজ্য যুদ্ধ মুক্ত বাণিজ্যের পরিপন্থী।
সরকারের হস্তক্ষেপ
মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা সীমিত থাকে। কিন্তু ট্রাম্পের নীতিতে সরকার বাণিজ্যে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, যেমন শুল্ক আরোপ এবং বিভিন্ন কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা। এটি মুক্ত বাজারের মূলনীতির বিরোধী, যেখানে সরকার বাজারকে নিজের মতো চলতে দেয়।
পরিশেষ
যে দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বাজারের ওপর নির্ভর করে, তাদের জন্য এটা পরিষ্কার, যদি যুক্তরাষ্ট্র তার বাণিজ্যযুদ্ধের নীতি একটু কমায়ও, তারপরও নতুন ধরনের বাণিজ্যিক ব্যবস্থার দরকার হবে।
বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মুখোমুখি অবস্থানে। এ যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা, ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে এর প্রভাব। বাণিজ্য ও নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রেই এটি (ট্রাম্পের উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ) চীনের জন্য অনেকটা অস্তিত্বের লড়াই।
বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেকে দূরে রেখে বাণিজ্যে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে চীন, যেমন সয়াবিনের মতো মার্কিন কৃষিপণ্যগুলোর ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে তারা। এখন এসব কৃষিপণ্যের বেশির ভাগ ব্রাজিল থেকে আসে। এ অবস্থায় ট্রাম্প নাকি চিন পিং—কে আগে হার মানবেন, সেদিকে তাকিয়ে আছেন বিশ্বের অনেকেই।
সত্যিকার অর্থে বেশির ভাগ দেশের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প নেই। আর এ বাস্তবতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সময় পাবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি আরেকটি বিকল্প বেছে নেওয়ার কৌশল গ্রহণ করবে।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ এবং বাণিজ্য নীতিগুলো আমেরিকার দীর্ঘদিনের প্রচারিত মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং উদার বিশ্ব বাণিজ্যের মূলনীতির বিপরীত। কাজেই, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ বিশ্ব বাণিজ্যে পণ্যের উৎসের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে। কোম্পানিগুলো ঝুঁকি কমাতে এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের সরবরাহ চেইনকে আরও বৈচিত্র্যময় করবে এবং মুক্ত বাজারের পরিবর্তে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

সিএজি কার্যালয়ে অডিট সংক্রান্ত বিশেষ সেবা কার্যক্রম চলছে
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়ের ৫২তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে চার দিনব্যাপী (১২-১৫ মে, ২০২৫) সারা বাংলাদেশের সকল নিরীক্ষা ও

“Significantly low price)” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

“ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট বা রেট কন্ট্রাক্ট” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি