প্রকল্প পরিচালককে হেনস্তার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ইং তারিখে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের হাতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এবং বিষয়টি পরদিনই প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে মূলতঃ ২টি অভিযোগ করা হয়েছে –
১। টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিষয় ফাঁস হওয়ায় প্রকল্প পরিচালকসহ ছয়জন দায়ী।
২। প্রকল্প পরিচালককে হেনস্তা ও ভাংচুরের ঘটনায় ১০ ঠিকাদারকে অভিযুক্ত।
এছাড়াও, প্রতিবেদনে মোট ১০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে যার মধ্যে বেশির ভাগই নিরাপত্তা সংক্রান্ত, বাকিগুলো দরপত্র এবং প্রশাসনিক বিষয় সংক্রান্ত।
বিস্তারিতঃ চসিকে প্রকল্প পরিচালক হেনস্তা ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল
নিরাপত্তা সংক্রান্ত সুপারিশঃ
-
- প্রত্যক কর্মকর্তার রুমে ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম সুইচ স্থাপন,
- সিটি করপোরেশনের প্রধান ফটকে প্রবেশকারীদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা, সেবাগ্রহীতাদের প্রবেশে সময়সীমা নির্ধারণ, বিকেল চারটার পর সিটি মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের অনুমতি ছাড়া দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, অফিস চলাকালে অফিসের সামনের রাস্তায় বহিরাগতদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে চেকপোস্ট বসানো,
- প্রত্যেক ফ্লোরে দুইজন নিরাপত্তাকর্মী রাখা,
- দরপত্র প্রক্রিয়া চলাকালে ঠিকাদারেরা ও তাঁদের লোকজনের অফিস এলাকায় অপ্রয়োজনীয় অনুপ্রবেশ সংরক্ষিত করা,
- দরপত্র প্রক্রিয়া চলাকালে নিরাপত্তাব্যবস্থা স্বাভাবিকের চেয়ে জোরদার করা।
দরপত্র সংক্রান্ত সুপারিশঃ
-
- ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা রোধে প্রকল্প গ্রহণ, প্রাক্কলন ও টেন্ডার কার্যক্রমের প্রত্যেক ফাইল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে মেয়রের অনুমোদন,
- টেন্ডারের তথ্য ফাঁস হওয়া রোধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যত্নবান হওয়া,
- প্রতিটি দরপত্র প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা–কর্মচারীদের নাম–পদবি সংরক্ষিত রাখা,
প্রশাসনিক সংক্রান্ত সুপারিশঃ
-
- চসিকের নিরাপত্তা বিভাগে কর্মরত কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা,
- সহকর্মীদের সঙ্গে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি করা।
এখন, উপরোক্ত অভিযোগ এবং সুপারিশের আলোকে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে একটু বিস্তারিত পর্যালোচনা করা যাক।
পর্যালোচনা ১
গত ২৯ জানুযারি ২০২৩ ইং তারিখে বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস কার্যালয়ের চতুর্থ তলায় প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ে কক্ষ ভাঙচুরসহ হেনস্তা করার ঘটনা ঘটে। এখন, তদন্ত কমিটির নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে সব সুপারিশ করেছে তা প্রকৃতপক্ষে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক কাজেরই অংশ। সুপারিশের কারনে হয়তো ভবিষ্যতে এগুলো নিয়ে আলাদা ভাবে কাজ করা হবে। কিন্তু, ২০-২৫ জন বিক্ষুব্ধ, উচ্ছৃঙ্খল লোকের দ্বারা প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের কক্ষ ভাঙচুর কোন স্বাভাবিক বা সাধারন ঘটনা নয়। এরকম জঘন্য এবং অনিভিপ্রেত ঘটনা অবলীলায় ঘটে যাওয়ার জন্য তদন্ত কমিটি কাউকে দায়ী না করায় এবং শাস্তির সুপারিশ না করায় সাধারণ মানুষের মনে কিছু সাদাসিধা প্রশ্ন আসতেই পারে।
এ বিষয়ে আরও দেখুনঃ প্রকল্প পরিচালককে নিরাপত্তার দায়িত্ব
পর্যালোচনা ২
তদন্ত প্রতিবেদন দরপত্র সংক্রান্ত যে সব সুপারিশ করা হয়েছে তা নিয়েও কথা আছে। এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত উল্লেখ করা উচিত বলে মনে করি –
ক) প্রকল্প গ্রহণ, প্রাক্কলন ও টেন্ডার কার্যক্রমের প্রত্যেক ফাইল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে মেয়রের অনুমোদন নিতে হবে মর্মে যে সুপারিশ করা হয়েছে তা মূল ঘটনার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে হয়। প্রকল্প গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে এই অনাকাংখিত ঘটনা ঘটে নাই এবং কোন পত্র-পত্রিকাতেই এ নিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রকল্প গ্রহণ, প্রাক্কলন ও টেন্ডার কার্যক্রমের অনুমোদন কি হবে তা ক্রয় আইন ও বিধি এবং সিটি করপোরেশনের আইন অনুযায়ি চলবে। সরকারের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ এবং Delegation of Financial Power এ কোন প্রকল্প গ্রহন, প্রাক্কলন ও টেন্ডার অনুমোদনের বিষয়ে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। বরং ক্রয় আইন ও বিধি বহির্ভূত ভাবে নথি অনুমোদন বা ক্রয় প্রক্রিয়া করা হলেই দরপত্র প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তা লংঘিত হবার আশংকা বেশি থাকবে। হটাৎ করে নতুন কিছু চাপানোর এখতিয়ার এই কমিটির আছে কি না তা নিয়েই সাধারণ মানুষের মনে কিছু সাদাসিধা প্রশ্ন আসা অমূলক নয়।
খ) আবার, আলোচ্য ঘটনার সময় একসাথে মোট ৩৭ লটের দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছিল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ৩৭টি লটের কাজ পেতে প্রায় এক হাজার ঠিকাদার অংশ নিয়েছিলেন। এতোগুলো দরপত্র একসাথে প্রক্রিয়া করা অনেক শ্রমসাধ্য এবং জটিল তা যারা সরকারি টেন্ডার মূল্যায়ন করে থাকেন বা এ বিষয়ে হাতে কলমে ধারনা আছে তারা মাত্রই বলতে পারবেন। এই জটিল ও দূরূহ কার্যক্রম হাতে গোনা দু-এক জনকে সাথে নিয়ে বা শুধু মাত্র প্রকল্প পরিচালক এবং মূল্যায়ন কমিটির একার পক্ষে অল্প সময়ে নির্ভূল ভাবে করা সম্ভব নয়। কাজেই বাস্তবিক ভাবেই দৈনিন্দিন দাপ্তরিক অন্যান্য কাজের পাশাপাশা এই বিশাল কার্যক্রমের তথ্য গোপন রাখা একেবারেই অবাস্তব। এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে কোন সুপারিশ বা তথ্য উঠে আসে নাই যা আশ্চর্য্য হবার মতোই বিষয়। আবার, বিদ্যমান ক্রয় আইনের ৩১ নং ধারা এবং ক্রয় বিধির ১৬ এর উপ-বিধি (৫ক) অনুযায়ি বাস্তবিক অর্থে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া গোপন রাখা যে এক অসম্ভব ও অসাধ্য তা ভুক্তভোগি মাত্রই বুঝতে পারবেন।
এ বিষয়ে আরও দেখুনঃ টেন্ডারে ঠিকাদারদের রেট সমান হওয়া এখন আর কাকতালীয় নয়
তদন্ত প্রতিবেদনে টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিষয় ফাঁস হওয়ায় প্রকল্প পরিচালকসহ ছয়জনকে দায়ী করা হয়েছে। যিনি ঘটনার শিকার, যিনি নাজেহাল হলেন, তাকেই উল্টো ঢালাও ভাবে দায়ী করা হলো ……… বিচিত্র এই প্রতিবেদন। দরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়নে, নিরপেক্ষতা বজায় রাখায়, গোপনীয়তা রক্ষায় প্রকল্প পরিচালকের যদি কোনো সাফল্য থেকে থাকে, তদন্ত প্রতিবেদনে তাও বলা প্রয়োজন ছিল।
গ) তদন্ত প্রতিবেদনে ঠিকাদারদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পটির যতগুলো টেন্ডার হয়েছে তার কোনোটির কাজ না পাওয়া এবং টেন্ডারের জামানত তাৎক্ষণিক ফেরত না পাওয়া। এছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক কাজ পাওয়ায় ঠিকাদারদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিলে বলে উল্লেখ করা হয়। ৩টি প্রতিষ্ঠানই নাকি পেতে যাচ্ছে ৩৭টির মধ্যে ৩৪টি লটের কাজ।
আসলে খোলা চোখে দেখলে এ ধরনের আশংকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ক্ষোভ তৈরি অস্বাভাবিক নয়। তবে, তদন্ত কমিটির উচিত ছিল বিষয়টির আরও গভীরে খতিয়ে দেখা। ৩টি প্রতিষ্ঠানই বেশিরভাগ কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে দরপত্র মূল্যায়নে কোন ক্রয় আইন বা বিধি লংঘিত হয়েছে কি না তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
উল্লেখ্য, বিদ্যমান ক্রয় আইন ও বিধির সুযোগে সরকারি ক্রয়ে যে বর্তমানে সব প্রতিষ্ঠানেই বড় ঠিকাদারদের রাজত্ব চলছে তা তো বিভিন্ন পত্র পত্রিকার রিপোর্টেই অনেকবার প্রকাশিত হয়েছে। শুধুমাত্র টার্ণওভারের দোহাই দিয়েই এক প্রতিষ্ঠান সব কাজ পেয়ে যাচ্ছে এরকম নজিরও আছে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ বড় ঠিকাদারদের রাজত্ব চলছে
ঘ) আবার, টেন্ডারের জামানত তাৎক্ষণিক ফেরত দেয়া বা না দেয়ার ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ এ সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কাজেই কোন প্রকল্প পরিচালক চাইলেই যখন তখন তা ফেরত দিতে পারেন না। কাজেই, টেন্ডারের জামানত তাৎক্ষণিক ফেরত না পাওয়ার বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক কোন ক্রয় আইন বা বিধি লংঘিত হয়েছে কি না তাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় নি।
ঙ) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহোদয় কর্তৃক গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির আহবায়ক ছিলেন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এবং অন্য দুই সদস্য ছিলেন আইন কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা। তারা তিনজনই এই একই প্রতিষ্ঠানেরই কর্মকর্তা। কমিটিতে কোন বহিঃসদস্য রাখা হয়নি। এছাড়াও, সরকারি ক্রয় আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কাউকে উক্ত কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত রাখা হয়নি। এক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিবেচনা নেয়া হলে তদন্ত প্রতিবেদনের নিরপেক্ষতা ও গুণগত মান নিশ্চিতভাবেই আরও বৃদ্ধির অবকাশ পেত।
পর্যালোচনা ৩
প্রশাসনিক সংক্রান্ত যে সুপারিশগুলো করা হয়েছে সে বিষয়গুলো যদি বিদ্যমান থেকেও থাকে তবুও এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। ঢালাও এবং দায়সারা ভাবে কেবলমাত্র প্রকৌশল শাখার সবাইকে দায়ী করা শুধু পাশ কাটানোর কৌশল বলে মনে হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন যে তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক এবং পূর্ণাংগ নয় তা উপরের আলোচনাতেই প্রতীয়মান।
পরিশেষ
এখন, কর্তৃপক্ষকে এমন একটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে যা সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এমন একটি স্পর্শকাতর তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, বিস্তারিত তথ্য সংযুক্ত হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য, দেখার জন্য তদারকি কর্তৃপক্ষেরও দায় আছে। অসম্পুর্ন তদন্ত প্রতিবেদনের কারণে কোন স্বার্থান্বেষী মহলকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে সাধারণ মানুষের মনে।
তদন্তকাজে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ভুল হলে তা প্রতিকারের উপায় হলো পুনঃ তদন্ত করা। তদন্ত কমিটির ভুল বা অবহেলার কারণে নিরীহ কেউ বিপদে পড়বে আর অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে, তা হতে পারে না। একবার তদন্ত শেষ হলে অধিকতর তদন্ত করারও সুযোগ রয়েছে। নতুন কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার সুযোগ অবশ্যই রয়েছে।
2 thoughts on “চসিকের তদন্ত প্রতিবেদনঃ কিছু সাদাসিধা প্রশ্ন”
লেখাটি খুব ভাল লেগেছে। একটা ক্যাডারকে সবসময় তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং যা কিছু হোক না কেন, তাদের ক্ষমতা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করে। যেমন: শিক্ষা কমিটির সভাপতি তারা হলে নাকি শিক্ষার মান উন্নত হবে! স্বাস্থ্য কমিটির সভাপতি তারা হলে নাকি স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হবে! তেমনি এখানেও একই সুপারিশ – প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে নথি গেলেই নাকি সব মুশকিল আসান হবে!!!
ধন্যবাদ