সাম্প্রতিক সময়ে ‘এন-৯৫’ মাস্ক ক্রয় নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারীতে সম্মুখসারির যোদ্ধাদের নিরাপত্তা জন্য ‘এন-৯৫’ মাস্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মহামারীর শুরু থেকেই মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই চিকিৎসকদের সেবা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে আসছে চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন। এ কারণে তাদের কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশি বলে জানিয়েছে সংগঠনগুলো।
শুধুমাত্র Registered ব্যবহারকারি গন-ই সব ফিচার দেখতে ও পড়তে পারবেন। একবছরের জন্য Registration করা যাবে। Registration করতে ক্লিক করুন।
এই মাস্ক ক্রয়ের মাঝ পথে এসে এখন এই অবস্থার জন্য কাঁদা ছোড়াছুড়ি চলছে। সামগ্রিক ঘটনা প্রবহগুলোকে প্রকিউরমেন্টের দৃষ্টিতে দেখা যাকঃ
১। গত এপ্রিলে মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ বেশকিছু হাসপাতালে ‘এন-৯৫’ মাস্কের নামে যেসব মাস্ক দেয়া হয়েছে, তার মান নিয়ে অভিযোগ করেন চিকিৎসকরা। বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে গত ১৯ এপ্রিল এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে এন-৯৫ মাস্কের নামে নিম্নমানের সাধারণ মাস্ক সরবরাহের ঘটনাকে পরিকল্পিত প্রতারণা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রতিবেদনটির আলোকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেছে মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে ওই তদন্ত কমিটি একতরফা তদন্ত করেছে। তাদের তদন্ত রিপোর্ট এখনও আলোর মুখ দেখেনি। তবে ওই তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে সিএমএসডির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সহীদউল্লাহকে প্রত্যাহার করা হয়।
২। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ‘এন-৯৫’ মাস্কের পরিবর্তে নকল ও ত্রুটিপূর্ণ মাস্ক সরবরাহ করায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় প্রতারণার মামলা করেছেন। মামলায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
৩। সরকার অনুমোদিত ডাইসিন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের নমুনা হিসেবে দেয়া মাস্কগুলো তুলনামূলক ভালো উল্লেখ করায় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানকে মাস্ক সরবরাহের জন্য একটি কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি চারটি লটে যথাক্রমে ১ হাজার ৩০০, ৪৬০, ১ হাজার ও ৭০০ পিস মাস্ক সরবরাহ করে। প্রথম ও দ্বিতীয় লটে দেয়া ১ হাজার ৭৬০টি মাস্কে কোনো ত্রুটি দেখা যায়নি। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ লটে দেয়া মাস্কগুলোয় ত্রুটি দেখা গিয়েছে। নকল মাস্কগুলোতে লেখা ভুল, লট নম্বর নেই। প্রকৃতপক্ষে আসল এন-৯৫ মাস্কের সঙ্গে নকল মাস্কও সরবরাহ করেছে কোম্পানি।
৪। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে গ্রেফতার অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহান বিচারককে বলেছেন, ‘আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি যদি নকল মাস্ক দিয়ে থাকি তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে সেটা ফেরত দেবেন। কিন্তু সেটা না করে আমার নামে মামলা দিলেন।’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানকে ১৮ জুলাই কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়। জবাবে শারমিন জাহান দুঃখ প্রকাশ করেছেন, যা দোষ স্বীকারেরই শামিল।
৫। অভিজ্ঞতা না থাকলেও কাজ পেয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসা ও সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের অতীত কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের। তার পরও বিএসএমএমইউর করোনা ইউনিটের চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদে
৬। বিএসএমএমইউর চিকিৎসকদের অভিযোগ, অতীত অভিজ্ঞতা না থাকলেও সুপারিশের জোরে হাসপাতালে মাস্ক সরবরাহের কাজ পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে হাসপাতালের এক করোনা চিকিৎসক বণিক বার্তাকে বলেন, অতীত কাজের অভিজ্ঞতা আছে কিনা, তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিএসএমএমইউর মতো হাসপাতালে মাস্ক সরবরাহের জন্য এমন অচেনা একটি প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের কার্যাদেশ দেয়ার সুপারিশটিই সন্দেহজনক। এর সঙ্গে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, কোনও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ছাড়াই নিজস্ব লোকদের মাধ্যমে এসব কেনাকাটা হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়নি, মান যাচাই না করে, যাচাই-বাছাই কমিটি ছাড়াই এসব কেনাকাটা সম্পন্ন করেছে কর্তৃপক্ষ।
৭। অন্যদিকে মাস্কের নমুনা পরীক্ষাসংক্রান্ত নিয়মনীতির ক্ষেত্রেও দুর্বলতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নিয়মনীতির এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই নিম্নমানের নকল মাস্ক আমদানি হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। চিকিৎসকরা বলছেন, মাস্ক ও অন্যান্য পিপিই কেনার সঙ্গে পরিচালক অফিসকে নিযুক্ত করা হয়। যাদের দায়িত্ব ছিল মাস্কের কোয়ালিটি নিশ্চিত করা, তারা ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শিক্ষক চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও ‘কোয়ালিটি নিশ্চিতের’ জন্য আলাদা একটি কমিটি করা যায়নি, এটা নিঃসন্দেহে একটি অব্যবস্থাপনা।
৮। অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের সরবরাহকৃত এন-৯৫ মাস্ক সরকারনির্ধারিত ডাইসিন ইন্টারন্যাশনালে পরীক্ষা করা হলেও তবে এ-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন নেই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। ফলে নমুনা হিসেবে ১০টি মাস্কের মান পরীক্ষা করেই আমদানির সনদ দিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে সে আমদানির সনদ কাজে লাগিয়ে কোন মানের ‘মাস্ক’ আমদানি করা হয়, তাতে কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না টেস্টিং প্রতিষ্ঠানের।
৯। বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) অনুসন্ধান করছে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য কেনা পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহে অনিয়মের ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে দুদক। সংস্থাটির পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলির নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের টিম এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করেছে।
উপরের ঘটনা প্রবাহগুলো বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগ্রহ করা। এর মধ্যে ক্রয় সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি, বিধি, practice, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ব্যবস্থাপনা, তদারকি, ইত্যাদি অনেক অনেক উপাদানের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অভিজ্ঞজনরা সহজেই বুঝতে পারবেন।