ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারী ইতোমধ্যেই অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার ঘোষণার জন্য বেশ চেষ্টা করা হচ্ছে। এরপরেও, এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। অন্তত জাতীয় পর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রচলন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বাংলা ভাষা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতাঃ সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে ১৯৮৭ সালের মার্চে পাস হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এ আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার করবে। নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। আইনে আরও বলা হয়েছে, উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে সেটা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। দীর্ঘদিন এ আইন অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে।
সরকারি ক্রয় ও বাংলা ভাষা ব্যবহারঃ সরকারি ক্রয় কার্যক্রম একটি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গূরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে প্রতি বছর বাংলাদেশ মোট ৭০০ কোটি ডলারের কেনাকাটা করে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই কেনা কাটা হয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি)। আর সরকারি ক্রয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ আর পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ি। ক্রয়কারিকে আদর্শ দরপত্র দলিল ব্যবহার করে দরপত্র আহবান করতে হয় এবং ঠিকাদার বা সরবরাহকারিদের সে অনুযায়ি দরপত্র দাখিল করতে হয়। বর্তমানে সিপিটিউ কর্তৃক মোট ৩০ টি আদর্শ দরপত্র দলিল প্রকাশ করা হয়েছে যার সবকটি-ই সম্পুর্ণ ইংরেজীতে।
এরূপ প্রেক্ষাপটে সরকারি ক্রয় কার্যক্রম অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য দরপত্র দলিল সুবান্ধব করা প্রয়োজন, অন্তত জাতীয় পর্যায়ে আহবানকৃত দরপত্র দলিলের জন্য তো অবশ্যই করা উচিত বলে সবার ধারনা। দরপত্র কার্যক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য প্লাটফর্ম হচ্ছে ই-জিপি পোর্টাল। ২০১১ সালে বাংলাদেশে ই-জিপি চালু হবার পর হতে তা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু ই-জিপি পোর্টাল সাইট টির শুধুমাত্র হোম পেইজের কিছু অংশ বাংলায় আছে। ভেতরের সকল কাজ ও নির্দেশনা ইংরেজীতে। ই-জিপি গাইডলাইনটি-ও ইংরেজীতে রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটঃ Islamic Development Bank (IDB) এর আদর্শ দরপত্র দলিলের Language and Interpretation অংশে জাতীয় পর্যায়ের দরপত্র আহবানের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের সুযোগ রাখা আছেঃ ‘Prequalification and Bidding documents for ICB and ICB/MC shall be prepared in one of the working languages of IDB (Arabic, English, or French). Documents may be prepared in local language as well, in the case of local bidding only’।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন পাবলিক প্রকিউরমেন্ট ডিরেকটিভ এর আর্টিকেল ৪৯ অনুযায়ি দরপত্র বিজ্ঞপ্তি ইউরোপিয় ইউনিয়নের যে কোন একটি সরকারি ভাষায় প্রকাশের পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত নোটিশ অনুমোদিত অন্যান্য ভাষায় প্রকাশ বাঞ্চনীয়। আবার আর্টিকেল ৬১ অনুযায়ি আদর্শ দরপত্র দলিল (European Single Procurement Document) সমূহ সকল অনুমোদিত ভাষায় প্রকাশ করতে হবে মর্মে গাইডলাইন করা আছে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের সরকারি ভাষা হল মোট ২৪ টি।
ব্রাজিলের অনলাইন দরপত্রের সাইট এবং দরপত্রের কার্যক্রম ইংরেজীর পাশাপাশি তাদের জাতীয় ভাষা পর্তূগীজ ভাষায় পরিচালিত হয়। মেক্সিকোর (compranet) স্পেনিশ ভাষায়, কানাডার Merx সিস্টেমে ফ্রেন্স ভাষায় আছে, দক্ষিন কোরিয়ার KONEPS সিস্টেম কোরিয় ভাষায় আছে। এ সকল ক্ষেত্রে তাদের স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজীতেও কাজ করা যায়। ব্যবহারকারিগন পছন্দমতে যে কোন একটি বেছে নিতে পারেন।
বর্তমান অবস্থাঃ ছোট এবং মাঝারি পূঁজির ঠিকাদার বা সরবরাহকারিরা যারা দেশের আনাচে কানাচে ছোট-মাঝারি সরকারি ক্রয়ের প্রান তারা এই সব ইংরেজি মাধ্যমের আদর্শ দরপত্র দলিল কতটুকুই বা ব্যবহার করতে পারে তা ধারনা করা খুব কঠিন নয়। এ বিষয়ে কয়েকজন নির্মান ব্যবসায়ি এবং সরবরাহকারির সাথে কথা হয়েছিল। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আপনি কি মনে করেন আদর্শ দরপত্র দলিল বাংলা ভাষায় হওয়া প্রয়োজন। শতকার ১০০ ভাগ উত্তর ছিল অবশ্যই প্রয়োজন। এতে তাদের অনেক বিষয় বুঝতে অনেক সহজ হত বলে তারা মনে করেন। আসলে সব সময় সব কাজ তারা নিজেরাও করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে অনেকের সহায়তা নিতে হয়। দরপত্র দলিল প্রস্তুতে এবং চুক্তি পরবর্তী কাজে তারা অনেক বিরম্বনার স্বীকার হন।
পরিশেষঃ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারতের কলকাতা বা আসামের সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে ইংরেজী ভাষার আদর্শ দরপত্র দলিল ব্যবহৃত হয়। কাজেই পৃথিবীর কোথায় বাংলায় আদর্শ দরপত্র দলিল নেই না তা হলপ করেই বলা যায়। এখন-ই সময়। আদর্শ দরপত্র দলিলগুলো অন্তত জাতীয় পর্যায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত দলিলগুলো বাংলা ভাষায় প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তবে আশার কথা, সিপিটিউ বর্তমানে এ বিষয়টা চিন্তা-ভাবনা করছে বলে শোনা যাচ্ছে। এখন তা কবে নাগাদ হবে তার উত্তর ভবিষ্যতেই জানা যাবে। দ্রুত হলেই মঙ্গল।