সারাটা দিন ট্রেনিং এ কেটে গেল। সকালের সেশন ছিল ক্লাশরুম ভিত্তিক আর বিকেলে ছিল ফিল্ড ভিজিট। যা সকালে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল তা বিকেলে মিলিয়ে দেখানোর আরেকটি প্রয়াস। কারিগরি এই ট্রেইনিং টির আয়োজক সড়ক ও জনপথ আধিদপ্তর। অংশগ্রহনকারি হিসেবে বেশিরভাগ সড়ক ও জনপথ আধিদপ্তরের প্রকৌশলীবৃন্দ। এছাড়াও ছিল এলজিইডি, বুয়েট, মীর আক্তার, আব্দুল মোনেম, পার্ল ইঞ্জিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন, ইত্যাদি সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রফেশনাল নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জনের টিম।
কোন রকম পরিচয় পর্ব ছাড়াই একেবারে ক্লাশরুমে বসিয়ে লেকচার শুরু হয়ে গেল। কারও কারও মধ্যে অনেক উচ্ছ্বাস … তারা কিভাবে জানি সামনের দিকে। কারও উচ্ছ্বাস কিছুটা কম মনে হল … তারা যথারীতি পেছনের সারিতে। আমি কোন সারিতে সেটা না হয় ধাঁধা হয়েই থাক। তবে, অনেক উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে মনে বলছিলাম … এই ছিল কপালে !!!
প্রথমেই শুরু করলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জাপানী ডেপুটি সেকশন ম্যানেজার মাসাতাকা টানিমোটো। তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রীজটি CFRP টেকনোলজি ব্যবহার করে কিভাবে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে তার সংক্ষেপ বিবরণ দিলেন। তারপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার CFRP টেকনোলজি নিয়ে ভাল মন্দ বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বেচারাকে অনেক উচ্ছ্বসিত মনে হলো। এরপর ক্লাশের শুরু করলেন বুয়েটের প্রফেসর এ এফ এম সাইফুল আমীন স্যার। তিনি বলতে গেলে কোন পড়ালেখায় গেলেন না। CFRP টেকনোলজি নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে গেল। সবশেষে কাঁচপুর ব্রিজটির সংস্কারে এই টেকনোলজি কিভাবে ব্যবহার হচ্ছে তার বিবরণ দিলেন মুহম্মদ মুখলেছুর রহমান, প্রজেক্ট ম্যানেজার, কাঁচপুর ব্রিজ প্রকল্প। পুরো সেশনের ফাঁকে ফাঁকেই হাল ধরছিলেন কাঁচপুর ব্রিজ প্রকল্পের পিডি জনাব আবু সালেহ মোঃ নুরুজ্জামান স্যার।
সকালের সেশন শেষ হবার পর বিষয়টা অনুধাবন করা শুরু করলাম। CFRP অর্থ Carbon fiber reinforced polymer। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী (স্টীলের থেকে দশ গুণের বেশি শক্তিশালী) এবং টেকশই কিন্তু হালকা fiber-reinforced প্লাস্টিক যা কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরী। শক্তিশালী ফাইবার পরিবারের এক অনন্য সদস্য কার্বন ফাইবার। কার্বন ফাইবারের মূল ব্যবহারসমূহ হলোঃ বিমান, রকেট, স্যাটেলাইট, অটো-মোবাইল, স্পোর্টস কার, এ্যাথলেটিক পারফরমেন্স, বিল্ডিং কাঠামো, মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্টে, ইত্যাদি। নির্মাণকাজে বিপ্লব নিয়ে এসেছে এই কার্বন ফাইবার।
এই CFRP টেকনোলজি নিয়ে আলোচনা করা আমার কাজ না। এর উপর অনেক লেকচার ইন্টারনেট ঘাটলেই পাওয়া যাবে। তারচেয়ে বরং ইন্টারনেটে যা পাওয়া যাবে না তাই হোক আলোচনার বিষয়।
দুটি কেস স্টাডি
২০১০ সালে রাজউক গাউছিয়া মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। এরপর সেখানে বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল এসে ভবনটি স্ক্যান করার পরামর্শ দেয়। স্ক্যান রিপোর্ট অনুযায়ি বিশেষজ্ঞরা কলামগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে মত দেন। এরপর মালয়েশিয়া এবং চীনের ভবন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী দুই বছরে সংস্কার কাজ করা হয়।
একশ বছরের গ্যারান্টি দেওয়া বঙ্গবন্ধু সেতুতে ২০০৬ সালে ফাটল দেখা দেয়। এরপর থেকেই কয়েকদফা সংস্কার কাজ করা হয়। সর্বশেষ কোরিয়ান এঞ্জেল কনসালটেন্ট ল্যাজারো এন্ড অ্যাসোসিয়েটসের পরামর্শে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ২০১২ সালের জুনে সেতুর ফাটল মেরামত শুরু করে। এখানেও বুয়েটের টিম যুক্ত ছিল।
বুয়েটের প্রফেসর এ এফ এম সাইফুল আমীন স্যার উপরের গল্প দুটি খুব সুন্দর করে বলছিলেন। দুটি ক্ষেত্রেই CFRP টেকনোলজি ব্যবহার করে সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। প্রথমবার CFRP শীট আনার সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষ বুঝতে না পারায় তা প্রায় আট মাস বন্দরে কাষ্টমস ক্লিয়ারিং এর জন্য আটকে ছিল। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দেন দরবার করার পর তা বিনা শুল্কে বুয়েটের অনুকুলে ছাড়পত্র দেয়া হয়। গাউছিয়া মার্কেট retrofitting এ CFRP শীট ব্যবহারে জন্য অনেক গবেষণার পর ACI code revise করে অতঃপর আমাদের দেশের উপযোগি করে এর coefficients নির্ণয় করা হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তিতে বিভিন্ন জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের নির্মান কাজে যে ধরনের পাথর ব্যবহৃত হয় তা অনেক নরম প্রকৃতির। ফলে অল্প লোডেই ফুলে যায়। আর এতেই CFRP শীট ব্যবহারে উপকারিতা বেড়ে যায়। এভাবে local technology এর সাথে ইনোভেটিভ আইডিয়ার সংমৃশ্রনে বাংলাদেশে CFRP টেকনোলজি ব্যবহারের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
অবশেষে কাঁচপুর ব্রীজের তলায়
বিকেলের সেশনটি ছিল বলতে গেলে অনেকটা হাতে কলমে। Seeing is believing …. দেখে দেখে শিখি। গাড়ি চলা অবস্থায় একটি জলজ্যান্ত ব্রীজের নিচে সংস্কার কাজ চলছে … অদ্ভুত। দেশের ইঞ্জিনিয়ারাও কাজ করছে। দায়িত্বরত বাংলাদেশি এবং জাপানি টিমের সদস্যরা আমাদের প্রত্যেককেই একেবার হাতে কলমে CFRP শীট ব্যবহার করে কিভাবে সংস্কার কার্যক্রম করা হচ্ছে তা দেখালেন। কিছু নমুনা ছবি দিলাম।
CFRP টেকনোলজি ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। CFRP fail করলে অনেক কম সময়েই collapse হয়। এটা অনেক ডেলিগেটেড আইটেম। এর জন্য ডেডিকেটেড টিম লাগে। এটি প্রায় বুলেট প্রুফ। কাজেই CFRP শীট লাইসেন্স আইটেম। চাইলেই ক্রয় করা যাবে না।
ঢাকায় ফেরার পথে যা ভাবছি
মোঃ মুখলেছুর রহমান। বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। অস্টঅস্ট্রেলি থেকে সবে মাত্র এই বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে এসেছে। সে তার প্রেজেন্টেশনের সময় বলছিল তার পিএইচডি শুরুর গল্প। ফুল স্কলারশিপে পিএইচডির অফার পাবার পরও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনবার ফাইল ফেরত পাঠানো হয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল এই বিষয় বাংলাদেশী কেউ সরকারি প্রকল্পে ইতিপূর্বে ব্যবহার করে নাই। কাজেই এটা কোন কাজে লাগবে না। আর এখন সে এই প্রজেক্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার। প্রজেক্ট ডাইরেক্টর নুরুজ্জামান স্যার তার জুনিয়র কলিগের যেই প্রশংসা করলো … তার আড়ালে। অপার্থিব।
বাংলাদেশে প্রকৌশলী সমাজ আজ দ্বিধাগ্রস্থ, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই ভুল ভেবে কতই না আক্ষেপ। বন্ধুরা সব ডিসি, এসপি হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ একটা বিপ্লব খুব নিরবেই ঘটে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এখন নির্মাণ শিল্পে সোনালী যুগ (Golden era) চলছে। দেশে এখন অনেক মেগা প্রজেক্ট চলমান। প্রায় সব সেক্টরেই বড় বড় … অন্তত একটা করে হলেও মেগা প্রজেক্ট চলছে। আর এসব মেগা সব প্রজেক্টই বিদেশী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে। এখনই শিখে নেয়ার সময়। পরবর্তীতে অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের মেগা প্রজেক্ট (যেমন ২য় কাঁচপুর সেতু সংস্কার, ইত্যাদি) গুলো বাস্তবায়নের সময় তো আমাদের দেশের প্রকৌশলীদেরই হাল ধরতে হবে। এতেই যদি প্রকৌশলী সমাজ তার হারানো গৌরব ফিরে পায়।
নদীর দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু প্রকৌশলীদের ক্ষেত্রে … ব্রীজের দেশ বাংলাদেশ। নদী পার হতে গেলে ব্রীজ লাগবেই। এখন নিজেদের নদীর উপর ব্রীজগুলো নিজেদেরই করতে হবে। সাইফুল আমীন স্যার খুব আশান্বীত হয়েই বললেন … তার সোনার ছেলেরা পিএইচডি করে দেশে ফিরে আসবে। যেমন এসেছে মোঃ মুখলেছুর রহমান।
এই রকম একটি নলেজ শেয়ারিং সেশন আয়োজন করার জন্য সড়ক ও জনপথ আধিদপ্তর কে ধন্যবাদ। অন্যরাও এটা অনুসরণ করতে পারে। উপকৃত হবে বাংলাদেশ।
কাঁচপুর ব্রীজের উপর দিয়ে কতবারই তো যাতায়াত করছি। কিন্তু নিচে কি হচ্ছে তা আমরা বুঝতেও পারি না। “ইঞ্জিনিয়ারিং” শব্দ টাকে অনেক ক্ষেত্রেই খারাপ অর্থে উপস্থাপন করা হয়। কাঁচপুর ব্রীজের তলায় আজ যা হচ্ছে তা ইঞ্জিনিয়ারিং এর এক আধুনিক প্রয়োগ … engineering inside। এসব যদি খারাপ হয় … … হোক। ভবিষ্যতের পৃথিবী CFRP এর পৃথিবী।
আচ্ছা … এতো কিছু বলবো আর প্রকিউরমেন্ট নিয়ে কিছুই বলবো না … তা কি হয়। যারা ভাবছেন … কথা ঠিক … কথা ঠিক। তাদের জন্য নিচের অংশ।
কাঁচপুর সেতুর সংস্কার কার্যক্রমের দরপত্র প্রক্রিয়া
ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রিজটি গত ৪০ বছরেও তেমন কোন মেরামত করা হয়নি। একই অবস্থা মেঘনা ও গোমতী সেতুর। ঝুঁকির মুখে থাকা এই তিনটি সেতুর জরাজীর্ণ অবস্থা এবং সড়কে যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যমান সেতুর পাশেই নতুন তিনটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তিনটি নতুন সেতু নির্মানের পাশাপাশি পুরনো তিনটি সেতুর মেরামত কাজও করা হবে। মেরামতের পর দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু হবে আট লেনের। নতুন ও পুরনো এই তিনটি সেতুই উপরের দিকে এক হয়ে যাবে। তবে নিচের দিকে পৃথক থাকবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়েছিল ২০১৩ সালের ১০ মার্চ। এরপর ওই বছরের ২৩ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেকে প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদিত হয়েছিল। আর একই বছরের ১৮ নভেম্বর প্রকল্পের বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। ২০১৫ এর জানুয়ারিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন ও আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে। পরে প্রকল্পে নির্মাণকাজের ঠিকাদার নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে জাপানের চারটি প্রতিষ্ঠান যথা ওবায়েসি করপোরেশন,শিমিজু করপোরেশন, জেএফসি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ও আইএইচআই ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিস্টেমস জয়েন্ট ভেঞ্চার (ওএসজেআই) এর মাধ্যমে ঠিকাদার হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হয়। ২০১৫ এর ১৫ অক্টোবর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এর অনুমোদন দেয়।
সেতু তিনটির সম্ভাব্যতা যাচাই,পরামর্শক নিয়োগ,নতুন সেতু নির্মাণ,পুরনো সেতুর পুনর্বাসন,নির্মাণকাজ তদারক,কাঁচপুরে একটি ফ্লাইওভার ও ইন্টারসেকশন নির্মাণসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাজে সম্ভাব্য ব্যয় হবে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। এ লক্ষ্যে ২৬ নভেম্বর,২০১৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।