সহজ কড়চাঃ কেন একই ধরণের কার্য ক্রয়ের দরপত্রে একই দরদাতা বার বার বিজয়ী হোন ?

আমিনুল ইসলাম
সিনিয়র সহকারি প্রকৌশলী (Procurement),
এলজিইডি
বাংলাদেশের সরকারী ক্রয়ের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। তা হল, কার্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে বার বার একই দরদাতা বিজয়ী হওয়া। মোটা দাগে অনেক কারণেই এই ঘটনা ঘটতে পারে। তবে, বাংলাদেশের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালায় এমন কিছু নিয়ম রয়েছে যেসব নিয়মের কারণে অনেক সময়ই একই ধরণের কার্য ক্রয়ের দরপত্রসমূহে বার বার একই দরপত্রদাতা বিজয়ী হওয়ার সুযোগ পান। এই বিষয়টিই সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চাই এই লেখায়।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এর ধারা ৩১ এর উপ-ধারা ৩ এবং ৪ এর সংস্থান নিম্নরূপঃ
“(৩) উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির অধীন অভ্যন্তরীণ কার্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোন দরপত্রদাতা কর্তৃক দরপত্রে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয় (Official Cost Estimate) ১০% (শতকরা দশ ভাগ) এর অধিক কম বা অধিক বেশি দর উদ্ধৃত করা হইলে উক্ত দরপত্র বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে।
(৪) উপ-ধারা (৩) এ উল্লিখিত দরপত্র মূল্য সমতার ক্ষেত্রে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে মূল্যায়ন ও কৃতকার্য দরদাতা নির্বাচন করিতে হইবে, কিন্তু লটারির মাধ্যমে কৃতকার্য দরদাতা নির্বাচন করা যাইবে না।”
যেহেতু, ±১০% এর সীমা অতিক্রম করলে দরপত্র বাতিল বলে গণ্য হয়, সেহেতু, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির অধীন অভ্যন্তরীণ কার্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে দরদাতাগণ উক্ত সীমার ভেতরে দরপত্র দাখিলের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, অর্থ বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত বিদ্যমান রেট সিডিউল উন্মুক্ত এবং সহজপ্রাপ্য হওয়ায় দরদাতাগণ প্রায়ই -১০% এ দর দাখিল করতে সমর্থ হন। ফলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাধিক দরদাতা সমদর তথা -১০% দরে দরপত্র দাখিল করেন। এক্ষেত্রে, উপ-ধারা ৪ এর সংস্থান অনুযায়ী লটারির সুযোগ না থাকায় দরপত্র দলিলের শর্ত অনুযায়ী ৩০০ নম্বরের Past Performance Evaluation Matrix এ মূল্যায়নের মাধ্যমে বিজয়ী দরদাতা নির্ধারণ করা হয়। উক্ত ম্যাট্রিক্সের তিনটি Criteria নিম্নরূপঃ
1. Total Number of Works Contract successfully completed within only PE’s organization during last 5 years (Contract Value of each Contract is up to +75% of the Official Cost Estimate of the proposed Work) (১৪০ নম্বর)
2. Total Value of Works Contract successfully completed within only PE’s organization during last 5 years (Contract Value of each Contract is up to +75% of the Official Cost Estimate of the proposed Work) (১০০ নম্বর)
3. Total Value of On-going works and Current Commitment under all PEs Organization as shown in Tender Capacity Formula (৬০ নম্বর)
[Reference: Standard Tender Document (National) For Procurement of Works [Open Tendering Method] (For any value above BDT 3 Crore) (Without Pre-Qualification) (Updated upto September 2022), ITT Clause 50.2]
এই ম্যাট্রিক্স-এ (মোট ৩০০ নম্বর) মূল্যায়নের ক্ষেত্রে “প্রথম নির্ণায়কঃ দরপত্রদাতা কর্তৃক ক্রয়কারীর সংস্থায় বিগত ৫ বছরে সম্পাদিত কাজের সংখ্যা” এবং “দ্বিতীয় নির্ণায়কঃ দরপত্রদাতা কর্তৃক ক্রয়কারীর সংস্থায় বিগত ৫ বছরে সম্পাদিত কাজের মূল্য”- এই দুইটি নির্ণায়কে মূল্যায়নের ৮০ শতাংশ (২৪০) নম্বর থাকায় যে ঠিকাদারের যত বেশি সংখ্যক কাজ সম্পাদিত রয়েছে তার জন্য নতুন দরপত্রে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি (আবার, নতুন কাজ পেলে পরবর্তী কোন দরপত্রে সেটি তৃতীয় নির্ণায়কের নম্বর বাড়ায়; নতুন কাজ সম্পাদনের পর পরবর্তী দরপত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় নির্ণায়কের মূল্যায়নে বেশি নম্বর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে)।
আরও দেখুনঃ OTM এর বেলায় e-GP তে দর সমান হলে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন
উল্লেখ্য, এই দুইটি নির্ণায়কের ক্ষেত্রে সম্পাদিত কাজের মূল্যের বিষয়ে একটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তা হল- Contract Value of each Contract is up to +75% of the Official Cost Estimate of the proposed Work, অর্থাৎ বিবেচ্য দরদাতার সম্পাদিত কাজের মূল্য ক্রয়তব্য কার্যের প্রাক্কলিত মূল্যের ১.৭৫ গুণ পর্যন্ত হলে ম্যাট্রিক্সের মূল্যায়নে গ্রহণযোগ্য হবে; এর বেশি মূল্যের চুক্তি গ্রহণ করা হবে না। যেমনঃ ক্রয়তব্য কার্যের প্রাক্কলিত মূল্য যদি ১ কোটি টাকা হয় তবে বিবেচ্য দরদাতার ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের চুক্তি পর্যন্ত এই দুইটি নির্ণায়কের বিপরীতে গ্রহণযোগ্য হবে; এক্ষেত্রে যদি বিবেচ্য দরদাতা ২ কোটি টাকা চুক্তিমূল্যের সম্পাদিত কোন কাজের তথ্য দরপত্রের সাথে দাখিল করেন তাহলে তা এই দুইটি নির্ণায়কের বিপরীতে গ্রহণযোগ্য হবে না, যেহেতু দাখিলকৃত সম্পাদিত কাজের চুক্তিমূলয় ক্রয়তব্য কার্যের প্রাক্কলিত মূল্যের ১.৭৫ গুণেরও বেশি।
অন্যদিকে, ক্রয়কারী সংস্থার আওতায় যেসব দরদাতাদের বিগত ৫ (পাঁচ) বৎসরে সফলভাবে বাস্তবায়িত চুক্তি সংখ্যা যত কম ম্যাট্রিক্স পদ্ধতিতে তার নতুন কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা তত কমতে থাকে, যা নতুন ঠিকাদারের অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করে।
ফলশ্রুতিতে, এই ম্যাট্রিক্সের মূল্যায়নে যদি কোন দরদাতা যথেষ্ট প্রতিযোগিতার পর একবার বিজয়ী হন, তাহলে একই ক্রয়কারী সংস্থা কর্তৃক আহবানকৃত কাছাকাছি প্রাক্কলিত মূল্যের সকল দরপত্রে উক্ত দরদাতার বিজয়ী হওয়ার অপার সম্ভাবনা তৈরী হয়। বিগত সময়ে আহবানকৃত দরপত্রসমূহের মূল্যায়নের তথ্য বিশ্লেষণ করে অনেক ক্ষেত্রেই এই বিষয়টির বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
এর সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এর ধারা ৩১ এর উপ-ধারা ৩ এবং ৪ রহিতকরণ অর্থাৎ, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির অধীন অভ্যন্তরীণ কার্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ±১০% এর সীমা বাতিল করা। যদিও, এর ফলাফল হিসেবে অতিরিক্ত নিম্নদর বা ঊর্ধ্বদরে দরপত্র দাখিলের প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। উক্ত প্রবণতা কমানোর জন্য দরপত্রের আর্থিক মূল্যায়নে পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ তথা দরদাতাদের প্রদত্ত দর এবং দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয়ের সমন্বয়ে প্রমিত বিচ্যুতি (Standard Deviation) এর ধারণা ব্যবহার করে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।
এই লিখাটি লেখকের লিঙ্কডইনে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত হওয়ায় এখানে আবারও প্রকাশিত হলো।
🔴🔵🟢 প্রকিউরমেন্ট, সাপ্লাই-চেইন, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আপনিও লিখতে পারেন। প্রাসঙ্গিক হলে ‘প্রকিউরমেন্টবিডি’তে প্রকাশ করা হবে।
