শ্রম সুরক্ষা ও পাবলিক প্রকিউমেন্ট: গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জ

১লা মে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশে যা মহান মে দিবস। দিবসটি শ্রমের ন্যায্য মূল্য, শ্রমিকের অধিকার এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার একটি মুহূর্ত।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শ্রমজীবী। শ্রম আইন কর্মীর কল্যাণ, সুরক্ষা এবং মর্যাদার নিশ্চয়তা দিলেও, সরকারি প্রকিউরমেন্ট আইন মূলতঃ নির্দেশ করে কিভাবে পণ্য, পরিষেবা এবং কাজের জন্য সরকারি তহবিল ব্যয় করা হবে। যদিও এগুলি আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টা পৃথক, কিন্তু এই আইনি কাঠামো ২টির কিছু কিছু বিষয় একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত – বিশেষ করে যখন শ্রম মানদণ্ড সরকারি ক্রয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এই প্রতিবেদনটি শ্রম আইন এবং প্রকিউরমেন্ট আইন/বিধিমালা মধ্যে তুলনা করে তাদের পার্থক্য এবং কিভাবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রকিউরমেন্ট-শ্রম সংযোগকে নতুন আকার দিচ্ছে তা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবে।
এ বিষয়ে আরও প্রতিবেদন দেখুনঃ সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া কি শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষন করছে ?
শ্রম আইন
কর্মীর সুরক্ষা শ্রম আইন প্রাথমিকভাবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে মনোযোগ দেয়:
- মজুরি এবং কাজের অবস্থা
- কাজের সময় এবং বিশ্রামের সময়
- পেশাগত স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা
- সমিতি গঠন এবং ইউনিয়ন অধিকারের স্বাধীনতা
- বৈষম্যহীনতা এবং অন্যায্য বরখাস্ত থেকে সুরক্ষা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত) তে মজুরি, কাজের সময়, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এবং কল্যাণ সম্পর্কিত ব্যাপক মানদণ্ড নির্ধারণ করা আছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এই বিষয় এবং প্রক্রিয়াগুলি আরও বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
সরকারি প্রকিউরমেন্ট আইন
সরকারি প্রকিউরমেন্ট আইন মূলতঃ সরকারি তহবিল পরিচালনায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে:
- স্বচ্ছতা এবং প্রতিযোগিতা
- অর্থের মূল্য (Value for money)
- সরবরাহকারীদের সাথে ন্যায্য আচরণ
- সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস ২০০৮ হল মূল আইনি উপকরণ। এগুলি ন্যায্যতা, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা এবং সরকারি সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের উপর জোর দেয়।
শ্রম আইন ও প্রকিউরমেন্টের সমন্বয়
১. প্রকিউরমেন্টে শ্রম মানদণ্ড অন্তর্ভুক্ত করা
আধুনিক প্রকিউরমেন্ট কার্যক্রমে বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন সংস্থায় ক্রমবর্ধমানভাবে শ্রম অধিকারকে চুক্তির কার্যকর ধারাগুলির অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
- ILO কনভেনশন ৯৪ (পাবলিক চুক্তিতে শ্রম ধারা) সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ন্যূনতম শ্রম মানদণ্ড মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা আরোপ করতে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশ এই কনভেনশনের পক্ষ নয়, তবে ফ্রান্স, নরওয়ে এবং ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলি এই ধরনের ধারাগুলিকে সংহত করে।
- দক্ষিণ আফ্রিকায়, তার সংবিধানের ধারা ২১৭ তে ঐতিহাসিক সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের অগ্রগতির জন্য প্রকিউরমেন্ট নীতি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়, যা শ্রম ন্যায্যতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
২. আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা থেকে উদাহরণ
- ইউরোপীয় আদালত (European Court of Justice) – রাফার্ট মামলা (Rüffert Case) (২০০৮): একটি জার্মান আঞ্চলিক সরকার ঠিকাদারদের পাবলিক নির্মাণ প্রকল্পে কর্মীদের স্থানীয় ন্যূনতম মজুরি প্রদান করতে বলেছিল। ECJ (ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস) রায় দিয়েছে যে এই সীমাবদ্ধতা EU প্রকিউরমেন্ট আইনের অবাধ চলাচল নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। ECJ বলেছে শ্রম ধারা অবশ্যই অযৌক্তিকভাবে আন্তঃসীমান্ত প্রতিযোগিতাকে সীমাবদ্ধ করবে না।
- ভারতঃ ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইব্যুনাল নির্মাণ টেন্ডারে শ্রম সুরক্ষা বিষয়ে (২০২১) ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছে যে টেন্ডার এ শ্রম কল্যাণ, সুরক্ষা প্রোটোকল এবং বীমা মেনে চলার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এটি নিশ্চিত করেছে যে সামাজিক ধারাগুলি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয় বরং আইনত বাধ্যবাধকতা।
বাংলাদেশে সুযোগ ও সম্ভাবনা
শক্তিশালী শ্রম আইন এবং একটি সুসংগঠিত প্রকিউরমেন্ট কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের সরকারি প্রকিউরমেন্টে শ্রম বিবেচনা খুব কমই কার্যকর হয়। যেমনঃ
- দরপত্র মূল্যায়ন বা চুক্তি সম্পাদনের সাথে শ্রম মানদণ্ড যুক্ত করার কোন বাধ্যতামূলক ধারা নেই।
- ঠিকাদাররা শ্রম বিধিমালা পাশ কাটিয়ে যায়, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে (যেমন, ছোট অবকাঠামো প্রকল্প)।
- দুর্বল প্রয়োগ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
করণীয়:
- টেন্ডার এবং চুক্তিতে শ্রম সম্মতিমূলক চেকলিস্ট অন্তর্ভুক্ত করা।
- পেশাগত স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা মেনে চলাকে একটি যোগ্যতা হিসাবে নির্ধারণ করা।
- প্রকল্প চলাকালীন নিরীক্ষণের অংশ হিসাবে শ্রম নিরীক্ষা চালু করা।
নীতি নির্ধারকদের জন্য সুপারিশ:
- প্রকিউরমেন্টে শ্রম সুরক্ষা ধারা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনে PPR 2008 সংশোধন করা, বিশেষ করে কার্য এবং পরিষেবা (Works and Physical Services) চুক্তির ক্ষেত্রে।
- প্রকিউরমেন্ট কর্মকর্তাদের শ্রম-সংযুক্ত প্রয়োজনীয়তাগুলি সনাক্ত করতে এবং প্রয়োগ করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
- জাতীয় শ্রম নীতির সাথে প্রকিউরমেন্ট এর ধারাগুলো সমন্বয় সাধনের জন্য BPPA এবং MoLE (শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়) এর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি।
- শ্রম আইন বা নীতিমালা মানায় গাফিলতি আছে এরকম ঠিকাদারদের চিহ্নিত করতে বা শাস্তি দিতে প্রয়োজনে ইলেকট্রনিক প্রকিউরমেন্ট প্ল্যাটফর্ম (e-GP) ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া।
পরিশেষ
উন্নয়নের আলোচনায় বিনিয়োগের পরিবেশ যতটা গুরুত্ব পায়, কর্মের পরিবেশ ততটা মনোযোগ পায় না। অথচ টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের যথাযথ কর্মপরিবেশ অর্থাৎ ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মস্থল, সংগঠিত হওয়ার অধিকারসহ সব ধরনের আইনি স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
প্রকিউরমেন্টে শ্রম দিবস যে কেবল ব্যয়-দক্ষতা সম্পর্কে সচেতন করে তা নয়, বরং তা নৈতিক এবং টেকসই ব্যবস্থা সম্পর্কেও শক্তিশালী অনুস্মারক হিসাবে কাজ করতে পারে। আইনি এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো সমন্বিত হলে শ্রম মান উন্নীত করার জন্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট একটি হাতিয়ার হতে পারে। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলায় এবং বৈশ্বিক ভালো উদাহরণগুলি প্রয়োগে, বাংলাদেশের প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থাকে শ্রমিকদের জন্য আরও শোভন, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করার একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

সিএজি কার্যালয়ে অডিট সংক্রান্ত বিশেষ সেবা কার্যক্রম চলছে
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়ের ৫২তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে চার দিনব্যাপী (১২-১৫ মে, ২০২৫) সারা বাংলাদেশের সকল নিরীক্ষা ও

“Significantly low price)” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

“ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট বা রেট কন্ট্রাক্ট” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি