কাজ পেলো একজন, করছে আরেক জন – চলবে আর কতদিন ?

টেন্ডারে চুক্তির পর কাজ বিক্রি নিয়ে অনেক অভিযোগ শোনা যায়। অনেকে বলেন এটা কাজ হাতবদল অথবে ঠিকাদারী লাইসেন্স ভাড়া দেয়া। প্রশ্ন হলো, এটা কিভাবে বন্ধ করা যায় ?
এই প্রশ্নটি বাংলাদেশের সরকারি টেন্ডার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত সমস্যা তুলে ধরেছে। চুক্তি পাওয়ার পর কাজ “বিক্রি” করে দেওয়া বা সাব-কন্ট্রাক্টে অন্যের কাছে হস্তান্তর করা খুবই সাধারন ঘটনা বাংলাদেশে। এটি প্রায়ই নিম্নমানের কাজ, বিলম্বিত প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতির ঝুঁকি তৈরি করে।
সরকারি প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জনে বড় অন্তরায় হয়ে উঠেছে কার্যাদেশপ্রাপ্ত লাইসেন্সধারী ঠিকাদারদের কাজের হাতবদল বাণিজ্য। প্রভাব খাটিয়ে কাজ পাওয়ার পর আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ঠিকাদাররা দ্বিতীয় পক্ষের কাছে তা বিক্রি করে দেন। দ্বিতীয় পক্ষ অধিক টাকায় বিক্রি করে তৃতীয় পক্ষের কাছে। এভাবেই হচ্ছে হাতবদল। তৃতীয় পক্ষ লাভ করতে গিয়ে কাজের সঠিক মান ধরে রাখতে পারছে না। এতে মূল ঠিকাদার প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের ’ঘুষ’ দিয়ে বাজেটের বেশিরভাগ টাকা তুলে নেন। সাব-ঠিকাদার সময়মত টাকা না পাওয়ায় সময়ক্ষেপন করেন। এসব কাজে সংশ্লিস্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের তদারকিতে গাফিলতির খবর প্রায়শ খবরের কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে।
দেখুনঃ সরকারি প্রকল্পের কাজ নিয়ে বিক্রি করে দেন ঠিকাদাররা
সাধারণত মধ্যম আকারের কাজ (সড়ক, ড্রেন, ব্রীজ, ইত্যাদি) সংক্রান্ত চুক্তিগুলোতে এই সমস্যা বেশি।
সমসাময়িক আরেকটি বিষয় দেখুনঃ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিজ দপ্তরে কনসালটেন্সি: বিষয়টি কিভাবে দেখছেন ?
এই কাজ বিক্রি থেকে মুক্তি পাওয়ার সাম্ভাব্য উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
যথাযথভাবে দরপত্র মূল্যায়ন করাঃ
ঠিকাদারদের দরপত্রে অংশগ্রহনে টেন্ডার ক্যাপাসিটি জমা দিতে হয়। এটা সঠিকভাবে অনেক সময় দেয়া হয় না। আবার মূল্যায়ন কমিটি-ও তথ্য প্রমাণ এবং সময়ের অভাবে সঠিকভাবে তা যাচাই করতে পারে না। ফলে দেখা যায় কম ক্যাপাসিটির ঠিকাদার কাজ পেয়ে যাচ্ছে। তখন এই ঠিকাদার কাজ করার স্বার্থেই কাজ বিক্রি করে দেয়।
চুক্তি প্রদানের আগে টেন্ডারদাতার প্রকৃত সক্ষমতা, যন্ত্রপাতি, জনবল, অভিজ্ঞতা, আর্থিক সামর্থ্য, ইত্যাদি পর্যাপ্ত যাচাই করতে হবে।
ঠিকাদারি লাইসেন্স এবং ট্র্যাক রেকর্ড মূল্যায়নঃ
এটার জন্য সহজ সমাধান হচ্ছে অনলাইন ডাটাবেজ। BPPA থেকেই টেন্ডারারস ডাটাবেজ (National Tenderer’s Database – NTDB) প্রস্তুতির কাজ চলছে। এলজিইডি নিজেও সারা বাংলাদেশে টেন্ডারারস ডাটাবেজ প্রস্তুতির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে তথ্য সংগ্রহ করেছে। কিন্তু এলজিইডি’র এই তথ্য এখনও ই-জিপি পোর্টালে সংযুক্ত করা হয়নি। ফলে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর তাদের নিজেদের প্রস্তুতকৃত Bidders Database Management System (BDMS) নামক সফটওয়ার ব্যবহার করে দরপত্র মুল্যায়ন ও রিপোর্ট প্রস্তুতের কাজ মোটামুটি সফল ভাবেই করছে। তবে, এই ক্ষেত্রে অন্যান্য দপ্তরের কাজগুলোর সকল তথ্য তাদের এই ডাটাবেজে নেই। এই BDMS এর সকল তথ্য-ও ই-জিপি পোর্টালে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেই কাজও সম্পন্ন হয়নি।
BPPA এবং সংশ্লিষ্ট ক্রয়কারি (Procuring Entity) যেন টেন্ডার ও চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যায়ে ডিজিটাল নজরদারি জোরদার করতে পারে এজন্যই একটি সার্বজনীন National Tenderer’s Database প্রয়োজন।
বিস্তারিতঃ দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়া আরও User Friendly হচ্ছে
আরও দেখুনঃ টেন্ডারারস ডাটাবেজ প্রস্তুতির সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে
সাব-কন্ট্রাক্টিং কে তদারকি করা:
চুক্তি দলিল অনুযায়ি কার্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সাব-কন্ট্রাক্টিং গ্রহনযোগ্য তবে তা অবশ্যই পুরো কাজ নয়। সাব-কন্ট্রাক্ট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়, তবে সেটা হতে হবে নীতিগত কাঠামোর মধ্যে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ারও বাধ্যবাধকতা আছে। কাজেই কাজ বিক্রি বন্ধ করতে হলে এই সাব-কন্ট্রাক্টিং কে ঠিকঠাক মতো তদারকি করতে হবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা (চুক্তি বাতিল, নিরাপত্তা অর্থ বাজেয়াপ্ত, কালো তালিকাভুক্তকরণ ইত্যাদি) গ্রহন করতে হবে।
সাব-কন্ট্রাক্টরদের তথ্য অনলাইনেই আপলোড বাধ্যতামূলক করতে হবে। ফলে তা তদারকি আওতায় আসবে। এছাড়াও, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রকৃত ঠিকাদার কাজ করছে কি না – তা পর্যবেক্ষণে মোবাইল টিম গঠন করা যেতে পারে।
সামাজিক জবাবদিহিতা ও নাগরিক পর্যবেক্ষণঃ
স্থানীয় জনগণ, সাংবাদিক, এবং নাগরিক সমাজ যেন কাজের গুণগত মান ও কারা করছে তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে, এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিটিজেন এনগেজমেন্ট সিস্টেম জোরদার করতে হবে। জনগনকে এই বিষয়ে কোথায় তথ্য পাওয়া যাবে এবং তা কিভাবে খুঁজতে হবে এই বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
পরিশেষ
বাংলাদেশে সরকারি টেন্ডার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা রক্ষা করতে হলে চুক্তিপ্রাপ্ত ঠিকাদার কর্তৃক কাজ “বিক্রি” বা অবৈধভাবে সাব-কন্ট্রাক্টে দেওয়া প্রবণতা বন্ধ করা জরুরি। এই সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা একসাথে কাজ করতে হবে। না হলে, এভাবে কাজ হাতবদল এবং ঠিকাদারী লাইসেন্স ভাড়ার রমরমা ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না।
আপনার কি মনে হয় ? এই কাজ বিক্রি থেকে মুক্তির কি আর কোন উপায় আছে ? থাকলে কমেন্টসে জানান।

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

সিএজি কার্যালয়ে অডিট সংক্রান্ত বিশেষ সেবা কার্যক্রম চলছে
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়ের ৫২তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে চার দিনব্যাপী (১২-১৫ মে, ২০২৫) সারা বাংলাদেশের সকল নিরীক্ষা ও

“Significantly low price)” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

“ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট বা রেট কন্ট্রাক্ট” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি