রিভলভিং ডোর (Revolving Door): সুযোগ নাকি সমস্যা !!!

“রিভলভিং ডোর” বলতে সরকারি খাত (যেমনঃ সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা) এবং বেসরকারি খাতের (বিশেষ করে একই শিল্পের) মধ্যে ব্যক্তিদের চাকরি পরিবর্তনের প্রবণতাকে বোঝায়। অর্থাৎ শব্দটি উঁচু পদের কর্মকর্তাদের সরকারি চাকরি থেকে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হওয়া বা এর বিপরীতে অবস্থা (vice versa) হচ্ছে এই “রিভলভিং ডোর”। একে বিশেষজ্ঞরা একটি সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ধারণাটি হল, দুটি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে একটি ঘূর্ণায়মান দরজা (Revolving Door) রয়েছে, যা দিয়ে পরস্পর যাওয়া আসা করা যায়।
গবেষণা অনুযায়ি ১৯৯৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিংয়ে ব্যয় করা অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৩.১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছিল। ২০১০-এর দশকে অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় এই রিভলভিং ডোর সমস্যাটি আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে। সেখানে সমস্যাটিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করার একটি উপায় হিসেবে ব্যাক্ষা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট সরকার সে সময় বেসরকারি খাতের রাজনৈতিক সমর্থন (Donations, Endorsements, ইত্যাদি) আদায়ের জন্য অভিজ্ঞ কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সরকারি আর্থিক নিয়ন্ত্রন সংস্থায় ঢালাও ভাবে নিয়োগ দিচ্ছিলো। এটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে কর্পোরেশন এবং বিশেষ স্বার্থ গোষ্ঠীগুলি সরকারে প্রভাব বাড়াতে এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদদের কাছে প্রবেশাধিকার পেতে তাদের অর্থ ব্যবহার করতে সক্ষম।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেও এই ধরনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, লবিং প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনীতিতে অর্থের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রিভলভিং ডোর ইফেক্টকে স্পটলাইটে এনেছে।
তবে, বর্তমানে সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য অথবা অতিরিক্ত প্রভাবশালী হওয়ার জন্য বেসরকারি চাকরিতে তাদের পূর্ববর্তী চাকরির অর্জিত সংযোগ এবং জ্ঞান কতটা ব্যবহার করতে পারবেন তা নিয়ে বর্তমানে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
Revolving Door এর উদাহরণ:
সরকার থেকে বেসরকারি খাতে: একজন কর কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে একটি কর পরামর্শক ফার্মে যোগ দিলেন। অথবা একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ শাখার আর্থিক বিষয় দেখার কনসাল্টেন্সি পেলেন। অথবা একজন প্রধান প্রকৌশলী সেই অধিদপ্তরেরই অধীন একটি প্রজেক্টে নিয়োজিত কনসাল্টেন্সি ফার্মের সুপারভিশন/মূল্যায়ন পরামর্শক হিসেবে যোগ দিলেন।
আরও দেখুনঃ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিজ দপ্তরে কনসালটেন্সি: বিষয়টি কিভাবে দেখছেন ?
বেসরকারি থেকে সরকারি খাতে: একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির নির্বাহী স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থায় ওষুধ অনুমোদনের দায়িত্ব পেলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক আইনপ্রণেতারা প্রায়ই লবিস্ট হিসেবে তাদের নিয়ন্ত্রিত শিল্পে যোগ দেন। লবিং ইন্ডাস্ট্রি বিশেষ ভাবে রিভলভিং ডোর ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়, কারণ একজন লবিস্টের প্রধান কৌশলই হল সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ এবং তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করা।
সাবেক FDA কর্মকর্তারা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে পূর্ব নিয়ন্ত্রণ নীতির ফাঁকফোকর ব্যবহার করতে পারেন।
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা প্রতিরক্ষা ঠিকাদারি সংস্থায় যোগ দিয়ে সামরিক চুক্তিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা প্রায়ই অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে যোগ দেন, যা অতিরিক্ত সামরিক ব্যয়ের প্রশ্ন তোলে।
প্রাক্তন প্রযুক্তি নির্বাহীরা যদি ডেটা প্রাইভেসি নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যোগ দেন, তবে তারা তাদের পুরনো কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দুর্বলতা দেখাতে পারেন।
Revolving Door সমস্যাজনক কেন ?
Revolving doors প্রতিযোগিতার সুবিধার পাশাপাশি প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অন্যায্য বন্টনের দিকেও নিয়ে যেতে পারে।
এটি একটি সুযোগ-সুবিধার দ্বন্দ্ব (Conflict of Interest) তৈরি করে, কারণ প্রাক্তন কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে যে পদে যোগ দেবেন, তার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আবার, বেসরকারি খাত থেকে আসা সরকারি কর্মকর্তারা তাদের পূর্বের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন করতে পারেন। ফলে, এই ধরণের কার্যক্রম স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest), নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রভাবিত হওয়া (Regulatory Capture) এবং কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্যায্য সুবিধার সৃষ্টি করতে পারে।
Revolving doors নীতির ফলে সরকার বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থাও ক্ষুণ্ন হতে পারে। নাগরিকরা মনে করতে পারেন যে সরকারি সিদ্ধান্ত জনস্বার্থের বদলে cooperate স্বার্থে নেওয়া হচ্ছে। যেমন, একজন প্রাক্তন জ্বালানি মন্ত্রী যদি তেল কোম্পানিতে যোগ দেন, তবে তা নীতি প্রভাবিত করার সন্দেহ তৈরি করে।
Revolving doors এর ফলে কোম্পানিগুলোর জন্য অবৈধ সুবিধা বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রাক্তন নিয়ন্ত্রকদের নিয়োগ দিয়ে কোম্পানিগুলো ভিতরের তথ্য ও লবিং শক্তি পায়, যা প্রতিযোগিতাকে বিকৃত করে। যেমন, প্রতিরক্ষা ঠিকাদাররা প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে সরকারি চুক্তি পেতে পারে।
বিশেষ বিবেচ্য বিষয়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তাদের কিভাবে এবং কখন বেসরকারি খাতে নিযুক্ত করা যেতে পারে তা নিয়ন্ত্রণ করে এমন বিস্তারিত নিয়ম রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তাদের হয় সামরিক ঠিকাদারের সাথে চাকরি নেওয়ার জন্য এক বছর অপেক্ষা করতে হবে অথবা তাদের সরকারি কাজের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই এমন কোনও ভূমিকা বা ইউনিটে স্থানান্তর করতে হবে। তবে, এই নিয়ম নীতিনির্ধারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যারা অবিলম্বে কর্পোরেশন এবং কোম্পানি বোর্ডে যোগ দিতে পারেন।
ফ্রান্সে, সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি খাতে কাজ করার জন্য তিন বছরের অপেক্ষার সময়কাল রয়েছে।
তবে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রমনা দেশগুলিতেও এই রিভলভিং ডোর এর প্রয়োগ প্রতিরোধ বা সীমিত করার জন্য তৈরি নীতি পর্যাপ্ত নয় এবং এর কার্যকারিতাও সীমিত।
সম্ভাব্য সমাধান
১. কুলিং-অফ পিরিয়ড (Cooling-Off Periods): প্রাক্তন কর্মকর্তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় (১-৫ বছর) বাধ্যতামূলক করা, যাতে তারা সংশ্লিষ্ট শিল্পে কাজ করতে না পারেন।
২. স্বচ্ছতা ও তথ্য প্রকাশ: লবিং কার্যক্রম এবং বেসরকারি চাকরির ইতিহাস জনসমক্ষে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা।
৩. কঠোর নৈতিক নিয়ম: কিছু উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ রূপান্তর নিষিদ্ধ করা (যেমন: FDA কর্মকর্তাদের ওষুধ কোম্পানিতে যোগ দেওয়া)। নীতিভঙ্গ করলে জরিমানা বা ভবিষ্যতে সরকারি পদে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া।
৪. সরকারি প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা: রাজনীতিতে বেসরকারি অর্থের প্রভাব কমানো এবং স্বাধীন তদারকি সংস্থা গঠন করা।
উপসংহার
রিভলভিং ডোর সমস্যা শাসনে আস্থা কমিয়ে দেয়, কারণ এটি সরকারি দায়িত্ব ও ব্যক্তিগত লাভের মধ্যে সীমাকে অস্পষ্ট করে। যদিও বিভিন্ন খাতের মধ্যে জ্ঞান বিনিময় উপকারী হতে পারে, তবে অনিয়ন্ত্রিত এই চলাচল দুর্নীতি, পক্ষপাত ও অসমতা সৃষ্টি করে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠা একেবারেই অসম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য প্রয়োজন – যেখানে অভিজ্ঞতা নৈতিকভাবে কাজে লাগানো হবে, কিন্তু জনস্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া হবে না।

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

সিএজি কার্যালয়ে অডিট সংক্রান্ত বিশেষ সেবা কার্যক্রম চলছে
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়ের ৫২তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে চার দিনব্যাপী (১২-১৫ মে, ২০২৫) সারা বাংলাদেশের সকল নিরীক্ষা ও

“Significantly low price)” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

“ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট বা রেট কন্ট্রাক্ট” নিয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ কী কী উল্লেখ আছে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত একটি অধ্যাদেশ হলো “পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫”। এই অধ্যাদেশটি